এত বছর পেরিয়ে এসে ইতিহাস কলম্বাসকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এমন এক পরিসরে, যেখানে নতুন এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় সেই ভ্রমণপিপাসু এক্সপ্লোরারকে। যার হৃদয়ে নতুন দেশ দেখার নেশার পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদী লোভও কম ছিল না।
ইতিহাস সাক্ষী, একা কলম্বাসকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। একই দোষে দোষী ভাস্কো ডা গামা থেকে হার্নান কর্তেজও। নতুন দেশে অভিযান চালানোর সময় তারা কেউই তাদের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতাকে লুকিয়ে রাখতে পারেননি।
কলম্বাসের নিষ্ঠুরতা প্রসঙ্গে ‘হিস্ট্রি অফ দ্য ইন্ডিজ’ বইয়ে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা আছে। জানা যায় নারী ও পুরুষ তো বটেই কলম্বাসের অত্যাচারের পরোক্ষ শিকার হয় শিশুরাও। কিউবায় মাত্র ৩ মাসে মারা যায় ৭ হাজার শিশু! আসলে তাদের মায়েরা কাজের ধকল, অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে এমন শারীরিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করেছিলেন স্তনদুগ্ধের ধারাই শুকিয়ে গিয়েছিল। ফলে না খেয়ে মৃত্যু হয় তাদের।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় বহু মা তাদের সদ্যোজাত সন্তানদের জলে ভাসিয়ে দিতেন! ঐ বইয়ে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ওই জনজাতির পুরুষদের মৃত্যু হয়েছিল খনিতে, নারীরা কাজের চাপে ও শিশুরা মায়ের দুধ না পেয়ে। চোখের সামনে এক স্বচ্ছল জনজাতির জীবনে নেমে এসেছিল মৃত্যু ও বিপর্যয়ের কালো ছায়া। যে ছায়ার আসল নির্মাতা কলম্বাস!
আমরা সবাই জানি, আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেছিলেন কলম্বাস। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, উত্তর ও মধ্য আমেরিকার উপকূলের আদিবাসী মানুষদেরই তিনি ভ্রান্তিবশত ‘ইন্ডিয়ান’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর কলম্বাস এসে পৌঁছান সান সালভা দর দ্বীপে। আজকের বাহামাসে অবস্থিত সেই দ্বীপটিতে পৌঁছে এক অজানা দেশ দেখার রোমাঞ্চের চাইতে কলম্বাসের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানকার সরল মানুষেরা। যাদের সহজেই ক্রীতদাস বানানো যাবে বলে তিনি ধরে নিয়েছিলেন।
আর তাই হয়তো অবসরপ্রাপ্ত অঙ্কোলজিস্ট লুইস বেলিজেট একটি লেখায় লিখেছেন, ‘কলম্বাস দাসপ্রথার উদ্ভাবন করেননি ঠিকই। কিন্তু প্রতিহিংসার সঙ্গে সেটির অনুশীলন করেছিলেন।’ আরেক জায়গায় তার দাবি, ‘কলম্বাস দাসত্ব, নির্যাতন ও ধর্ষণের আমদানি করেছিলেন তার আবিষ্কৃত ‘নতুন বিশ্বে’র সর্বত্র।’
যাইহোক, তার লেখায় কলম্বাসের ডায়েরির যে অংশ তিনি তুলে ধরেছেন তা পড়লে চমকে উঠতে হয়। কলম্বাস লিখছেন, ‘ওদের শরীর সুগঠিত, সুন্দর ও সুঠাম আকৃতির… ওদের কাছে অস্ত্র তো নেই-ই। এমনকি সেটার ব্যবহারও জানে না ওরা। আমি যখন ওদের দিকে তরোয়াল এগিয়ে দিলাম, ওরা ভুল করে সেটার ধারালো অংশে হাত দিয়ে ফেলায় রক্তারক্তি কাণ্ড। ওরা লোহার ব্যবহার জানে না। এরা দারুণ দাস হতে পারবে। ৫০ জন মিলেই আমরা ওদের আয়ত্তে এনে ফেলতে পারব এবং ওদের দিয়ে যা খুশি করাতে পারব।’
আরেক জায়গায় রয়েছে ‘ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে যখন আমি পৌঁছলাম, প্রথম দ্বীপটায় নেমেই আমি কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দাকে জোর করে পাকড়াও করলাম। যাতে ওরা আমাদের ভাষা বুঝে আমাদের প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে পারে।’
তার দ্বিতীয় অভিযান ছিল আজকের হাইতিতে। কলম্বাস যার নাম দিয়েছিলেন হিস্প্যানিওলা। সেখানে উত্তর আমেরিকার আরাওয়াক জনজাতির হাজার হাজার মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছিলেন তিনি। তাদের মধ্যে ৫০০ জনকে স্পেনে বিক্রি এবং চালান করে দেওয়া হয়। যাদের মধ্যে ২০০ জন যাত্রার সময়ই মারা যায়!
এমনটাই বলছে এই সব বই। এমনকি, কলম্বাসের প্রতি সবচেয়ে সহানুভূতিশীল, তার আত্মজীবনীকার হার্ভার্ডের স্যামুয়েল এলিট মরিসনও মেনে নিচ্ছেন, যে নিষ্ঠুর নীতির প্রবর্তন করেছিলেন কলম্বাস তা পরবর্তী সময়ে তার উত্তরসূরীরা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এর ফলশ্রুতি ছিল সম্পূর্ণ গণহত্যা।
গবেষক ক্রিস লেন মনে করেন, কলম্বাস যা করেছিলেন সেটাকে ‘গণহত্যা’ বলা ঠিক নয়। তেমন কোনো উদ্দেশ্য সত্যিই ছিল না কলম্বাসের। কিন্তু পরিবার সূত্রে পাওয়া বাণিজ্যের কৌশল ও অবহেলার কারণে তিনি মানুষকে ঠেলে দিয়েছিলেন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ