যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, তারা ঐতিহাসিক দাস ব্যবসার আয় থেকে বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছে। খবর রয়টার্সের। বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়টি সরাসরি এ অমানবিক ব্যবসায় জড়িত ছিল না বলেও জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
মূলত ইতিহাস কুখ্যাত দাস ব্যবসার আয় থেকে বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পরিচালিত এক গবেষণায়ই উঠে এসেছে এ তথ্য।
ব্রিটেনকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে দাসপ্রথার কেন্দ্রীয় ভূমিকা এবং কীভাবে এই অমানবিক ব্যবস্থা থেকে তারা উপকৃত হয়েছিল তা পুনর্মূল্যায়ন করছে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড থেকে শুরু করে চার্চ অব ইংল্যান্ড পর্যন্ত শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই মধ্যে ক্যামব্রিজ কর্তৃপক্ষ দাস ব্যবসা থেকে লাভবান হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলো।
২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর স্টিফেন টুপের নিয়োগ করা লিগ্যাসিস অব এনস্লেভমেন্ট অ্যাডভাইজরি গ্রুপ একটি গবেষণায় এ তথ্য জানায়।
তবে এতে বলা হয়েছে, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি কখনো দাসদের মালিক ছিল না বা, এ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্তও ছিল না বলে তদন্তে প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, তারা দাস প্রথা থেকে ‘‘উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সুবিধা’’ পেয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সুবিধা বা অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়টির শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে এসেছিল যারা দাস ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করত। দাস ব্যবসায় সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনিয়োগ এবং এতে সম্পৃক্ত পরিবারগুলোর কাছ থেকে অর্থ বা সুবিধা পেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
গবেষকরা দেখেছেন, ক্যামব্রিজ কলেজের তৎকালীন একাধিক ফেলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অন্যদিকে রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের সঙ্গেও ক্যামব্রিজের সম্পর্ক ছিল। আর এই দুটি কোম্পানিই ক্রীতদাস ব্যবসায় সম্পৃক্ত ছিল।
উভয় কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অনুদানও পেয়েছিল ক্যামব্রিজ। এছাড়া ক্রীতদাস ব্যবসায় সক্রিয় সাউথ সি কোম্পানিতে সরাসরি বিনিয়োগ করেছিল এই উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি।
লিগ্যাসিস অব স্লেভমেন্ট নামের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ‘‘এই ধরনের আর্থিক সম্পৃক্ততা দাস ব্যবসাকে সহজতর করতে সাহায্য করেছিল এবং ক্যামব্রিজে খুব গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সুবিধা এনে দিয়েছিল।’’
রিপোর্টের প্রসঙ্গে ভাইস চ্যান্সেলর স্টিফেন টোপ বলেন, ঐতিহাসিক ভুলকে ঠিক করা আমাদের হাতে নেই। তবে আমরা ভুলটা স্বীকার করে নতুন করে শুরু করতে পারি।
ঐতিহাসিক এই নিপিড়নের সাথে আমাদের সংযুক্ততা সবার সামনে আসায়, এটা নিয়ে আমরা আরও গভীরভাবে কাজ করার উৎসাহ খুঁজে পাবো। পাশাপাশি বর্তমান বর্ণবাদকেও চিহ্নিত করা হবে। বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গদের উদ্দেশ্য করে যে বর্ণবাদমূলক আচারণ করা হয়।
বহু আগে দাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও বিষয়টি নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। ২০১৯ সালে ঔপনিবেশিক আমলে আটলান্টিকের ক্রীতদাস ব্যবসায় ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় লাভবান হয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখার ঘোষণা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি খুঁজতে দুই বছরের এইভএকাডেমিক গবেষণাটি তখন শুরু হয়।
মূলত আফ্রিকা থেকে দাস এনে পরিচালিত এ ব্যবসায় ক্যামব্রিজ আর্থিকভাবে কেমন লাভবান হয়েছে, তা জানাই এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল। পাশাপাশি ১৮০০ সাল থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বর্ণবাদী চিন্তাভাবনাকে উসকে দিয়েছে, এমন বিষয়গুলোও চিহ্নিত করার জন্য ছিল এই গবেষণা।
ব্রিটিশ গবেষকদের মতে, ১৫০০ শতাব্দী থেকে ১৯০০ শতাব্দী পর্যন্ত দাস হিসেবে এক থেকে দুই কোটি ৮০ লাখ মানুষকে সমুদ্রপথে নিয়ে আসা হয়েছিল। যাদের অনেকেই মাঝপথে প্রাণ হারিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত যারা জীবিত ছিলেন, অমানুষিক শ্রমের বিনিময়ে জীবনের বাকি অংশ তাদের কাটাতে হয়েছে চিনি, তামাক কিংবা তুলাক্ষেতে।
দাসব্যবসা ১৮০৭ সালে ব্রিটেনে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ হয়েছিল, তবে ব্রিটেনের পুঁজিবাদের উত্থান আর বিশ্বশক্তি হিসেবে ব্রিটেনের আবির্ভাবের মূল খুঁটি হিসেবে কাজ করেছে এই নির্মম ব্যবসা৷
পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, পর্তুগাল স্বর্ণের খোঁজে আফ্রিকার উপকূল ‘আবিষ্কার’ করে৷ পর্তুগাল ছিল প্রথম ইউরোপীয় দেশ, যারা আফ্রিকায় গিয়েছিল। এইসময়ে, দাসব্যবসাও শুরু হয়েছিল, তবে স্বল্প পরিমাণে। স্বর্ণই ছিল সবচেয়ে সৌভাগ্যের জিনিস।
যেমন, ১৪৭০ সালে পর্তুগিজরা ‘স্বর্ণ উপকূল’ নামে পরিচিত ঘানায় গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে, আমরা দেখি আফ্রিকা থেকে ইউরোপে স্বর্ণ বাণিজ্য হচ্ছে৷ এইসময়ে, পর্তুগালকে হটানো ছাড়া ব্রিটেনের আধিপত্য বিস্তার সম্ভব হতো না। যদিও পরবর্তীতে, দাস হিসেবে মানুষের কেনা-বেঁচা আরো লাভজনক ব্যবসা হিসেবে হাজির হয়।
এইসময় ব্রিটেনও দাসব্যবসা শুরু করে৷ দাসব্যবসায় ব্রিটেন যুক্ত হয় ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে৷ খুব দ্রুতই ট্রান্স-আটলান্টিক অঞ্চলে দাসব্যবসার স্থপতি রূপে হাজির হয় ব্রিটেন৷ এর মাধ্যমে, একটি পুঁজিবাদী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটানোর জন্য যে উচ্চমূল্যের মুনাফা দরকার ছিল, সেটা দাসব্যবসার মুনাফার মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছিল।
যেসব কোম্পানিগুলো দাস ব্যবসায় যুক্ত ছিল, তারাই শিল্প বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল পরবর্তীতে। উদীয়মান পুঁজিবাদী শ্রেণীর জন্য বিশ্ববাণিজ্য বিস্তারে দাসব্যবসাই প্রধাণ ভূমিকা পালন করেছিল। কার্ল মার্ক্সের ভাষায়-
“দাসপ্রথাই কলোনিগুলোকে মূল্যায়িত করে, আর এই কলোনিগুলোর মাধ্যমেই বৈশ্বিক বাণিজ্য শুরু হয়। বৈশ্বিক বাণিজ্য সেসময়কার যন্ত্রনির্ভর ভারী শিল্প-কারখানার জন্য খুব দরকারী ছিল। দাসব্যবসার আগে, পূর্বের জামানায় কলোনিগুলো থেকে খুব কম পণ্যই রপ্তানি হতো, এবং সেটা পৃথিবীর চেহারা পাল্টে দেবার ক্ষেত্রেও তখন তেমন কোন পরিবর্তন ঘটায়নি।”
এইসময় ব্রিটেনও দাসব্যবসা শুরু করে৷ দাসব্যবসায় ব্রিটেন যুক্ত হয় ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে৷ খুব দ্রুতই ট্রান্স-আটলান্টিক অঞ্চলে দাসব্যবসার স্থপতি রূপে হাজির হয় ব্রিটেন৷ এর মাধ্যমে, একটি পুঁজিবাদী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটানোর জন্য যে উচ্চমূল্যের মুনাফা দরকার ছিল, সেটা দাসব্যবসার মুনাফার মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছিল।
যেসব কোম্পানিগুলো দাস ব্যবসায় যুক্ত ছিল, তারাই শিল্প বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল পরবর্তীতে। উদীয়মান পুঁজিবাদী শ্রেণীর জন্য বিশ্ববাণিজ্য বিস্তারে দাসব্যবসাই প্রধাণ ভূমিকা পালন করেছিল। কার্ল মার্ক্সের ভাষায়ঃ
ব্রিটেনের আধিপত্য চুড়ায় উঠেছিল ১৬৪০ থেকে ১৮০৭ সাল পর্যন্ত, যখন ব্রিটেনের দাস ব্যবসা কৌশলে নামমাত্র আনুষ্ঠানিকতা পালনের মধ্যে দিয়ে ‘উচ্ছেদ’ করা হয়েছিল৷ আমেরিকায় যদিও গৃহযুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই প্রথা টিকে থাকে৷ শেষ হয় ১৮৬৫ সালে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১৫
আপনার মতামত জানানঃ