পশ্চিম তীরের জেনিনে গত ১১ মে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন আল–জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ। ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ৫১ বছর বয়সী এ সাংবাদিক ঘটনার দিন সুরক্ষিত পোশাক পরে ছিলেন। তার পোশাকে প্রেস লেখা ছিল। অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে ছিলেন শিরিন। হঠাৎ একটি গুলি এসে তার গায়ে লাগে, মারা যান শিরিন।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদন জানিয়েছে, আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর সম্ভাব্য হত্যাকারী সৈনিকের বিচারকাজ পিছিয়ে দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়ার ল্যাপিড।
গত সোমবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছে যে তাদের একজন সেনা সম্ভবত আবু আকলেহকে যোদ্ধা ভেবে গুলি করেছিল। এর আগে তারা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীদের দায়ী করেছিল।
ইসরায়েলের দখলকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে গত ১১ মে অভিযান চালায় দেশটির সেনারা। সংবাদ সংগ্রহের জন্য সেখানে ছিলেন ৫১ বছর বয়সী শিরিন আবু আকলেহ। প্রত্যক্ষদর্শী ও তার সহকর্মীদের অভিযোগ, ইসরায়েলের এক সেনা মাথায় গুলি করলে শিরিন আবু আকলেহ প্রাণ হারান।
হামলার সময় সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার আরেক সাংবাদিক আলী আল-সামুদির পিঠে গুলি লাগে।
আল-জাজিরার প্রবীণ সাংবাদিক শিরিনের মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। তখন তিনি ‘প্রেস’ লেখা একটি বুলেটপ্রুফ পোশাক ও হেলমেট পরে ছিলেন। শিরিনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড বিশ্বজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিল।
এর আগে গত ১১ মে সেনাবাহিনী তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলেছিল, আবু আকলেহ সম্ভবত ঘটনাচক্রে বন্দুকের গুলির শিকার হয়েছিলেন। এমনটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাকে ফিলিস্তিনি বন্দুকধারী মনে করে গুলি করা হতে পারে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়ার ল্যাপিড একটি সামরিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘শুধু বিদেশিদের সাধুবাদ পাওয়ার জন্য আমি এমন একজন সৈনিকের বিচারের অনুমতি দেব না, যিনি সন্ত্রাসীদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের সৈন্যদের প্রতি ইসরায়েল সরকার ও জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।’
শুধু বিদেশিদের সাধুবাদ পাওয়ার জন্য আমি এমন একজন সৈনিকের বিচারের অনুমতি দেব না, যিনি সন্ত্রাসীদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের সৈন্যদের প্রতি ইসরায়েল সরকার ও জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।’
এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমরা ইসরায়েলকে তাদের নীতি ও কার্যকলাপ পর্যালোচনার জন্য চাপ দিতে যাচ্ছি। কীভাবে বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকি কমানো যায়, সে ব্যাপারটিও বিবেচনা করতে যাচ্ছি আমরা।’
গত জুনে জাতিসংঘ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, আবু আকলেহকে যখন গুলি করা হয়েছে, তখন সে এলাকার কাছাকাছি ফিলিস্তিনিদের কোনো কার্যকলাপের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তবে ইসরায়েলের একজন সামরিক আইনজীবী সোমবার বলেছেন, ‘সেখানে অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল এমন সন্দেহ করার কোনো প্রমাণ নেই। ফলে ফৌজদারি তদন্ত করারও ন্যায্যতা নেই।’
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করে বলেছে, ইসরায়েলি সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে আবু আকলেহকে টার্গেট করে হত্যা করেছে। তবে ইসরায়েল এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়ার ল্যাপিড বলেছেন, ‘ইসরায়েল তার মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেছে। এটি অবশ্যই একটি দুঃখজনক ঘটনা। ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে, সেখানে ইসরায়েলের শত্রুরা ছিল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কখনোই ইচ্ছাকৃতভাবে নিরপরাধ কারও ওপর গুলি করে না।’
এদিকে ইসরায়েলি তদন্তের ফলাফলের নিন্দা করেছে আল-জাজিরা। আন্তর্জাতিক এই গণমাধ্যম একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তদন্ত দাবি করেছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট ১৯৯২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েল ও অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভুখন্ডে ১৭ জন সাংবাদিক নিহত হওয়ার নিশ্চিত ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে ১৫ জন সাংবাদিক সরাসরি ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহত হন।
২০১৯ সালে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল কমিশনের রিপোর্ট বলছে, সাংবাদিকদের পরিকল্পিতভাবে গুলি করে ইসরায়েলি স্নাইপাররা। কারণ এ সব সাংবাদিকদের শরীরে থাকা জ্যাকেটে পরিষ্কার করে প্রেস শব্দ লেখা ছিল। তবে এই প্রতিবেদনকে পক্ষপাতদুষ্ট ও বিকৃত দাবি করে নাকচ করে দিয়েছে ইসরায়েল।
রিপোর্টার্স উইথাউট বর্ডার্স বলছে, শুধু টার্গেট কিলিংই নয়, ২০১৮ সালের গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন প্রটেস্টসের পর থেকে ইসরায়েলি রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস ও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন ১৪৪ সাংবাদিক। গেল বছর পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জাররাহতে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি ও আরব-ইসরায়েলিদের ঘর দখল ইস্যুতে প্রতিবাদের খবর সংগ্রহের সময় আল-জাজিরার সাংবাদিক গিভারা বুদেরিকে টেনে-হিচড়ে পুলিশ ভ্যানে তুলে নেয় ইসরায়েলি বাহিনী। বিশ্বজুড়ে সমালোচনার পর তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় দেশটি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ