বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে পৃথিবীর সব দেশে তাপমাত্রা বাড়ছে, এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থা খুবই নাজুক। উচ্চ তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, খরা এবং বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত এ অঞ্চল।
মেরু অঞ্চলের বাইরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হিমবাহের অবস্থান পাকিস্তানে। তবে জলবায়ু উষ্ণ হতে থাকায় এসব হিমবাহ হঠাৎ গলে পানি লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছে।
সিএনএন ও রয়টার্সের প্রতিবেদনে পাকিস্তানের প্রধান আবহাওয়াবিদ সরদার সরফরাজ সতর্ক করে বলেছেন, শুধু চলতি বছরই বিভিন্ন হ্রদে হিমবাহ গলার পরিমাণ অন্য সময়ের তুলনায় তিন গুণ বেশি হয়েছে। এসব হ্রদের হিমবাহ দ্রুত গলে পানি লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়লে বন্যা পরিস্থিতি বিপর্যয়কর হতে পারে।
পাকিস্তানে বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা মাক্সার টেকনোলজির স্যাটেলাইট চিত্রে ধরা পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটি এসব ছবি প্রকাশ করেছে। গত ৩০ আগস্ট স্যাটেলাইটে এসব ছবি ধারণ করা হয়।
আবহাওয়াবিদ সরদার সরফরাজ বৃহস্পতিবার বলেছেন, দেশের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা গিলগিত-বালতিস্তানে ২০২২ সালে এমন ১৬টি ঘটনা ঘটেছে। অথচ অতীতে বছরে এমন পাঁচ–ছয়টি ঘটনা দেখা যেত।
রয়টার্সকে সরফরাজ বলেন, ‘উষ্ণতা বাড়ার কারণে হিমবাহ গলতে থাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। এর জন্য মূলত জলবায়ু পরিবর্তনই দায়ী।’
জলবায়ু সংকট বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে স্পষ্ট ও দৃশ্যমান চিহ্নগুলোর একটি হলো হিমবাহ গলে যাওয়া। তবে পাকিস্তানের বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির সঙ্গে হিমবাহ গলে যাওয়া সম্পর্ক কতটুকু, সে ব্যাপারে এখনো পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। তবে সরফরাজ মনে করেন, যত দিন বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের হার না কমানো যাবে, তত দিন পর্যন্ত হিমবাহগুলো দ্রুতগতিতে গলতে থাকবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে জলবায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী গ্যাসগুলো যে পরিমাণে নির্গত হয়ে থাকে, তার ১ শতাংশেরও কম উৎপন্ন করে পাকিস্তান। তবে গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, এটি জলবায়ু সংকট ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর তালিকায় অষ্টম অবস্থানে আছে।
কয়েক মাস ধরে এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তানে রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। দেশটির উত্তর পার্বত্য অঞ্চলে রেকর্ড মাত্রায় হিমবাহ গলতে দেখা গেছে। এতে জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে বন্যা দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত বন্যার কারণে কমপক্ষে ১ হাজার ১৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বন্যাকে ‘নজিরবিহীন জলবায়ু বিপর্যয়’ বলে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ। দেশটিতে গড় বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। শুধু আগস্টেই ১৫ দশমিক ৪ ইঞ্চি বৃষ্টির রেকর্ড হয়েছে।
জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, পাকিস্তানের জন্য অবিলম্বে প্রায় ১৬০ ডলার সহায়তা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, পানিবন্দী অবস্থায় বসবাসকারীদের কারণে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
দেশটির উত্তর পার্বত্য অঞ্চলে রেকর্ড মাত্রায় হিমবাহ গলতে দেখা গেছে। এতে জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে বন্যা দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত বন্যার কারণে কমপক্ষে ১ হাজার ১৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিমালয়ের বরফ গলার পরিমাণ অতিতের সব রেকর্ড ভেঙ্গেছে। অতিমাত্রায় হিমালয়ের বরফ গলার কারণে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতিও আরও খারাপ হয়েছে বলে দাবি করেছে একদল ভারতীয় গবেষক।
প্রতি বছর আবহাওয়া উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের দল দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য হিমাচল প্রদেশের ছোট শিগ্রি হিমবাহ অধ্যয়নের জন্য হিমালয় পর্বতমালা ভ্রমণ করেন। গত দেড় দশক ধরে তারা তুষার আচ্ছাদনের পরিমাণ রেকর্ড করেছেন, বাতাস এবং মাটির তাপমাত্রা পরীক্ষা করেছেন, বরফের গঠনের পৃষ্ঠ পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং নীচের নদী উপত্যকাগুলিকে মৌসুমী তুষার গলিত স্রাব পরিমাপ করেছেন।
তাদের গবেষণামতে, এ বছর গলিত হিমবাহ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
ইন্দোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গ্ল্যাসিওলজিস্ট মোহাম্মদ ফারুক আজম বলেন, ‘আমরা জুন মাসে এটি ইনস্টল করেছিলাম এবং আগস্টের মধ্যে আমরা অবশিষ্টাংশগুলিও খুঁজে পাইনি। গ্রীষ্মের শুরুতে মার্চ এবং এপ্রিলে আমরা তীব্র তাপপ্রবাহ দেখেছি যা গত ১০০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এর প্রভাবও আমরা দেখেছি, ফলাফল হিমবাহ গলে যাওয়া। আমাদের দল গত সপ্তাহে একটি হিমবাহে ছিল এবং আমরা হিমালয়ে রেকর্ড-ব্রেকিং গলতে দেখেছি।’
চলতি বছর পৃথিবীজুড়ে আমরা যে পরিমাণ তাপপ্রবাহ দেখেছি তার প্রভাব কেবল ইউরোপের আল্পস পর্বতে নয়, বরং আইকনিক হিমালয় পর্বতমালায় তুষার এবং বরফ গলার মাধ্যমেও দেখতে পেয়েছি। হিমালয়ের পর্বতগুলি মূলত উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুগুলির বাইরে হিমায়িত স্বাদু জলের বৃহত্তম রিজার্ভ।
বৈশ্বিক উষ্ণতা হিমালয়ের হিমবাহের ক্ষতিকে ত্বরান্বিত করছে। এর প্রভাব সবচেয়ে তীব্র হয়েছে পাকিস্তানে। সাম্প্রতিক বন্যা দেশটির কৃষিজমি এবং শহরগুলিকে নিমজ্জিত করেছে, ৩ কোটির বেশি মানুষকে প্রভাবিত করেছে এবং এর ফলে জুন থেকে ১ হাজারের বেশি মানুষ মারাও গেছে।
হিমবাহ গলে যাওয়া আরব সাগরের উষ্ণতা এবং লা নিনার আবহাওয়া বিপর্যয়ের প্রভাবে তীব্র মৌসুমি বৃষ্টিপাত ঘটেছে। বিষয়টিকে পাকিস্তানের কর্মকর্তারা ‘জলবায়ু বিপর্যয়’ বলে অভিহিত করেছেন। সেই প্রলয় অবশ্য শুরু মাত্র।
যারা জলবায়ু নিয়ে সরব এবং সচেতন, তাদের কাছে বিষয়টি তেমন অবাক হওয়ার মতো নয়। খুব কমসংখ্যক পাকিস্তানিই পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কিছুসংখ্যক লোকের দ্বিমত আছে, বিপরীতে পাকিস্তানে এই কিছুসংখ্যক লোকই জলবায়ু পরিবর্তন, বৈষ্ণিক উষ্ণায়নের মতো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়।
আত্মতুষ্টির যুগ হয়তো শেষের দিকে। জার্মানির একটি থিংক ট্যাংক সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় পাকিস্তানকে ৫ নম্বরে স্থান দিয়েছে। ইয়েল ইউনিভার্সিটির পরিবেশগত কর্মক্ষমতা সূচকের তথ্য আরও বেশি উদ্বেগজনক। এই সূচকে পাকিস্তানের অবস্থান ১৭৬।
জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানের প্রায় সব জায়গাতেই লোকজন জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মুখীন হচ্ছে। কিছু এলাকায় বন্যা প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে; অন্যান্য এলাকা খরায় জর্জরিত। হিমবাহের বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে, ফলে নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা হ্রাস খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে। এসব কারণে গ্রাম থেকে ব্যাপকহারে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে।
বনাঞ্চল ধ্বংস তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আমাদের হিমবাহের বরফ গলে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে উচ্চ তাপমাত্রা কমাতে হবে। পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় পাকিস্তানে হিমবাহের সংখ্যা বেশি। এই হিমবাহ রক্ষার জন্য এখনই জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন। পর্বতারোহীদের কাছে একসময় উত্তর পাকিস্তান স্বর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু এখন এই এলাকাও বন্যার হুমকিতে আছে।
গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের বৃহৎ একটি অংশের জন্য দায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলি। পাকিস্তান তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। আন্তর্জাতিক জল ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পাকিস্তানের প্রতিনিধি মহসিন হাফিজের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অষ্টম দেশ পাকিস্তান। তবে দেশটি গ্রহ-উষ্ণায়ন গ্যাসের বৈশ্বিক নির্গমনে ১ শতাংশ অবদান রাখে।
হাফিজ বলেন, ‘পাকিস্তানকে আরও সতর্ক হতে হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সক্ষমতা গড়ে তুলতে আরও ব্যবস্থা নিতে হবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৬
আপনার মতামত জানানঃ