সুমিত রায়
বিগত দুইদিনের নিউজ চ্যানেল ঘাটলেই ইরাকের সংঘর্ষের ব্যাপারটা নজরে আসবে। খবরগুলোতে যা বলা হচ্ছে তার সারমর্ম হচ্ছে, প্রভাবশালী শিয়া ক্লেরিক মুকতাদা আল সাদরের রাজনীতি থেকে পদত্যাগের পর তার সমর্থকরা বাগদাদের গ্রিন জোনে, মানে যেখানে প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেস, পার্লামেন্ট, ডিপ্লোমেটিক ভবন সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন আছে সেখানে ঢুকে পড়েছে। বাগদাদ ছাড়াও কারবালা, বসরা সহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ চলছে। পুলিস বরাবরের মতই বিক্ষোভ থামাতে ব্যস্ত। ন্যাশনওয়াইড কারফিউ জারি করা হয়েছে। শেষ জানা খবরে ২৩ জন আন্দোলনকারী মারা গেছে। আন্দোলনকারীরা বলছে পার্লামেন্টের ডিজোল্যুশন চান, এই পার্লামেন্ট করাপ্টেড। যাই হোক, আসল পরিস্থিতি কী, কেন এই আন্দোলন, দেশটিতে কী সংকট চলছে তা জানতে একটু পিছিয়ে আপাতত ২০২১ সালের অক্টোবরের ইলেকশনে যেতে হবে। আর তারও কারণ খুঁজলে যেতে হবে সেই ইউএস ইনভ্যাশনে …
২০২১ এর ১০ অক্টোবরে ইরাকে পার্লামেন্টারি নির্বাচন হয়। ইরাকি পার্লামেন্টে ৩২৯টি সিট। মেজোরিটি পাবার জন্য ১৬৫টি সিটের দরকার ছিল, মুকতাদা আল সাদরের দল সাদরিস্ট মুভমেন্ট পেয়েছে ৭৩টি সিট। ২০১৮ এর মে মাসে নির্বাচনেও আল সাদর সবচেয়ে বেশি ৫৪টি সিট পেয়েছিলেন। এবারে তার চেয়ে ১৯টি সিট বেশি পেয়ে ৭৩টি সিট পেয়েছেন। আল সাদরের পার্টি সাদ্রিস্ট মুভমেন্ট একটি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল। দলটির আইডিওলজিগুলো হলো শিয়া ইসলামিজম, রিলিজিয়াস কনজারভেটিজম, ইরাকি ন্যাশনালিজম, পপুলিজম, অ্যান্টাই আমেরিকানিজম, অ্যান্টাই জায়োনিজম। কুর্দিশ ন্যাশনালিজম বাদ দিয়ে ইরাকের প্রধান পলিটিকাল পার্টিগুলো রাইট উইংগার ও ইসলামিস্ট। ২০১৯ সালে মোহাম্মদ আল হালবৌসি প্রোগ্রেস পার্টি বা আল-তাকাদুম মুভমেন্ট শুরু করে। এটাই কুর্দিশ ন্যাশনালিস্ট না এমন একটি প্রথম প্রধান সেক্যুলার পার্টি হিসেবে উঠে আসে। এদের আদর্শ হলো লিবারালিজম, লিবারাল ডেমোক্রেসি, ননসেক্টারিয়ানিজম, সেক্যুলারিজম, রিফর্মিজম। ২০২১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে এরাই আল সাদরের দলের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৭টি সিট লাভ করে। ৩৩টি সিট পেয়ে পূর্বের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকির স্টেট অফ ল কোয়ালিশন ৩৩টি ভোট পেয়েছে, এরাও অ্যান্টাই-সেক্যুলার পার্টি। প্রধান দল হলো নুরি আল মালিকির ইসলামিক দাওয়াহ্ পার্টি, যা ইসলামিক ডেমোক্রেসি, অ্যান্টি-জায়োনিজম আদর্শ ধারণ করে। আরেক প্রধান দল কুর্দিশ ডেমোক্রেটিক পার্টি ৩১ সিট পেয়েছিল, যারা কুর্দিশ ন্যাশনালিজম ও সেক্যুলারিজম আদর্শ ধারণ করে। হাদি আল আমিরির ইসলামিস্ট, অ্যান্টাই-সেক্যুলারিস্ট ও প্রো ইরানী দল ফাতাহ্ ৩১টি সিট হারিয়ে ১৭টি সিট লাভ করেছে। কুর্দিশ ন্যাশনালিস্ট আরেকটি দল কুরদিস্তানি কোয়ালিশন পেয়েছে ১৭টি সিট। সুন্নিদের আজেম অ্যালায়েন্স ১৪টি সিট পেয়েছে। বাকি দল বা অ্যালায়েন্স ১০টিরও কম সিট পেয়েছে।
যাই হোক ৭৩টি সিট দিয়ে মেজোরিটি পাওয়া যায়না। অনেকে বলেন তিনি মেজোরিটি না পাওয়াতেই সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। আজকে ডয়েচে ভেলের সংবাদে দেখলাম সেরকম ইঙ্গিতই দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয়না সেটা ঠিক। আমার মতে, তিনি ইস্তফা দিয়েছিলেন সংসদে প্রো-ইরান সদস্যদের মেজোরিটি আসায়। এদের মোট সংখ্যা ৭৩ এরও বেশি হয়ে গেছিল, আর এরা একটি ব্লক গঠন করলে রাষ্ট্রের একটা বড় ক্ষমতা ইরানের হাতে চলে যায়, এটা ভেবেই তিনি আমার মতে ইস্তফা দেন। এই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন ইলেকশনের পর দেশটির রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে জানলে। বলা যাক…
২০২১ সালের অক্টোবরে ইরাকের পার্লামেন্টারি ইলেকশনের পর দেশটির পার্লামেন্ট বা কাউন্সিল অফ রিপ্রেসেন্টেটিভের সদস্যরা কোন স্থিতিশীল কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে না পারলে একটি পলিটিকাল ক্রাইসিস শুরু হয়। ১০ মাস ধরে দেশটি পলিটিকাল ডেডলকের মধ্যে রয়েছে। ইলেকশনের পর বাগদাদে একটি বড় সংঘর্ষ ঘটে। প্রো-ইরানিয়ান জোট ফাতাহ্ এলায়েন্স এই নির্বাচনে ৩১টি সিট হারিয়ে ১৭টি সিট লাভ করে, যার ফলে ফাতাহ্ এর সাপোর্টাররা আন্দোলন শুরু করে। মূলত হেজবোল্লাহ্ এর মত ইরান ব্যাকড মিলিশিয়া ও প্রো-ইরান পলিটিকাল পার্টি এই আন্দোলনে ছিল। তারা ইট-পাথর ছোড়া শুরু করে ও গ্রিন জোন এরিয়ায় ঢোকার চেষ্টা করে যেখানে সকল গভার্নমেন্ট বিল্ডিং ও এম্বাসি রয়েছে। আন্দোলনকারীরা গ্রিন জোনের সব এক্সেস বন্ধ করে ইট পাটকেল ছুড়তে থাকে। পুলিশ গুলি ছুড়ে ও টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে তাদের বিতাটির করে। এতে ১২৫ জন আহত হয় ও ২ জন মারা যায়। এরপর ৭ নভেম্বর তদকালীন প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা আল-কাধিমিকে গুপ্তহত্যা করার চেষ্টা করা হয়। এর পেছনেও শিয়া জঙ্গিরা কাজ করেছে। আর এভাবেই নির্বাচনের পর দেশটির নতুন পলিটিকাল ক্রাইসিসের সূচনা ঘটে। বুঝতে পারছেন, এন্টাই ইরান সাদরের সমর্থকদের মত প্রো-ইরানরাও অনেক সময়ই গ্রিন জোনে ঢুকে যায়…
এই বছর ৯ জানুয়রিতে প্রথমবারের মত নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ স্পিকার ও তার দুই ডেপুটি নির্বাচনের জন্য গ্রিন জোনে মিলিত হয়। বিবাদপূর্ণ পার্লামেন্টারি সেশনের পর মাহমুদ আল মাশাহাদানিকে স্পিকার নির্বাচন করা হয়, কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলে, পরে প্রোগ্রেস পার্টির প্রধান মোহাম্মদ আল হালবৌসিকে (ধর্মে সুন্নি) স্পিকার করা হয়। ২০১৮ সাল থেকে তিনি স্পিকার আছেন, এবারে সেকন্ড টার্মে স্পিকার হলেন। ডেপুটি নেয়া হলো কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির শাখাওয়ান আবদুল্লাহ্ আর সাদ্রিস্ট মুভমেন্টের হাকিম আল জামিলিকে। এভাবে তিন পার্টির লোকই তিনটি পজিশন পেয়ে গেলেন, যারা তাদের নিজেদের ব্লকগুলোর ভোটে এই ক্ষমতায় এলেন। এটা দেখে শিয়া প্রো-ইরানীয় মেম্বাররা ক্ষেপে গেলেন। তারা বললেন সব পার্টি যোগ করে শিয়া প্রো-ইরান মেম্বার আসন এখন ৮৮টা, যা সাদ্রিস্ট মুভমেন্টের ৭৩টি সিটেরও বেশি। এদের এই বিরোধিতার ফলে অস্থায়ীকালের জন্য পার্লামেন্ট সাসপেন্ডেড হয়, তবে ইরাকি সুপ্রিম কোর্ট তা আবার চালুর নির্দেশ দেয়।
ইরাকের সংবিধান অনুসারে, পার্লামেন্ট স্পিকারের নির্বাচনের ৩০ দিনের মধ্যে একজন প্রেসিডেন্টকে সিলেক্ট করতে হবে। প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন অফ কুর্দিস্তান ইতিমধ্যে থাকা প্রেসিডেন্ট বাহরাম সালিহ্কে দ্বিতীয়বারের মত রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে (রাষ্ট্রপতির পদটি সিম্বলিক ধরতে পারেন, আসল ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে)। এদিকে কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রাক্তন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হোশিয়ার জেবারিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। যাই হোক, বিবাদ চলতে থাকলো সরকারও গঠন হলো না, প্রেসিডেন্টও না। এরপর ২০২২ সালের ১৩ই জুনে আল সাদরের ব্লকের ৭৩ জন সংসদ সদস্য পার্লামেন্ট থেকে রিজাইন করেন। ২৩ জুনে তাদের জায়গায় ৭৩ জন নতুন সদস্যকে সংসদে শপথ পড়ানো হয়। এর ফলে নুরি আল মালিকির নেতৃত্বে ইরান সমর্থিত পার্টিগুলোর নতুন ব্লক, কোঅর্ডিনেশন ফ্রেমওয়ার্ক ব্লক ১৩০টি সিট দখল করে। ১৭ জুলাইতে নুরি আল মালিকির কিছু সিক্রেট রেকর্ডিং ফাঁস হয়ে যায়, যেখানে তিনি আল-সাদরের সমালোচনা করছিলেন। এটি খুব বিতর্কের সৃষ্টি করে।
২৫শে জানুয়ারিতে ইরান সমর্থিত ব্লকটি প্রাক্তন মন্ত্রী ও মায়সান গভর্নরেটের প্রধান মোহাম্মদ শিয়া আল সুদানিকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করে। এরপর ২৭ই জুলাইতে, ইরাকি ডোমেস্টিক গভার্নেন্সে এত বেশি ইরানের প্রভাবের কারণে আল সাদরের অনুসারিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে গ্রিন জোন ও ইরাকি পার্লামেন্টে ঢুকে যায়। এরপর আল-সাদর একটি পাবলিক মেসেজে বলেন, ওখানে নামাজ পড়ে ঘরে ফিরে যাও, তাতে সবাই ফিরে যায়। এরপর ৩রা অগাস্টে আল-সাদর স্ন্যাপ ইলেকশনের ডাক দেন। কিন্তু ২৯শে আগস্ট গতকাল তিনি তার রাজনৈতিক জীবন থেকে ইস্তফা দেন। আর তার পরই এই অবস্থা। তার সমর্থকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে আবার প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেসে প্রবেশ করে। এর ফলে অন্তত ১৫ জন আন্দোলনকারী নিহত হয়। ইরাকি সেনাবাহিনী ন্যাশনওয়াইড কারফিউ জারি করে। দক্ষিণাঞ্চলীয় ইরাকের বসরা ও মায়সান গভার্নরেটেও বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ ঘটে। আজ ৩০শে অগাস্টে কারবালায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে যায় এবং বসরায় তা বৃদ্ধি পায়, যেখানে বিক্ষোভকারীরা কারবালার পার্লামেন্টারি অফিসে প্রবেশ করে এবং উম কাসির পোর্টের প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়। এখন পর্যন্ত শোনা খবরে মৃতের সংখ্যা ২৩। এমন হতেই পারে যে, মেজোরিটি না পেয়ে গণতন্ত্রে আস্থা হারিয়ে আল সাদর রিজাইন করেন ও তিনি এখন অন্য উপায়ে রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতা গ্রহণ করতে চান। আর সেজন্যই তার এই পদত্যাগের নাটক। তবে আসলেই দেশটির রাজনৈতিক গতি কী হবে তা সময় বলে দেবে।
কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ইরাকে এই অবস্থা কেন? কেন ইরান এদের পলিটিক্সে এত নাক গলাচ্ছে বা গলাতে পারছে। কেন লিডারশিপ খণ্ডিত, কেন দেশ দুর্নীতিতে নিমগ্ন, কেন জনগণের এত অনাস্থা, কেন তারা এত বিক্ষুব্ধ হচ্ছে, কেন দেশে এত বেশি দারিদ্র্য বেড়ে গেছে? উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করা যাক…
২০০৩ সালে ইউএস ইরাকে যুদ্ধ শুরু করে। ১৯ বছর হয়ে গেছে, ইউএস সেখানে কোন উইপন্স অফ মাস ডেস্ট্রাকশন পায়নি। তারা দেশটিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে চলে গেছে। এখন আমেরিকার এই একশনের মূল্য শোধ করছে ইরাক। শেষ ১৯ বছরে দেশটি একের পর এক সংকটে ভুগছে। বিক্ষুব্ধ জনতা ইরাকি পার্লামেন্টে জোর করে ঢুকে পড়েছে। এটা দেখে কলম্বোর ঘটনা মনে হতে পারে, কিন্তু ইরাকের ঘটনা খুব কলম্বোর থেকে ভিন্ন, শ্রীলঙ্কার চেয়েও খারাপ। ২১ সালের অক্টোবরের পর থেকে ১০ মাস ধরে ইরাক পলিটিকাল ডেডলকে। কোন পার্টি মেজোরিটি পায়নি। আর তখন থেকে ল-মেকাররা কোন ডিলে যেতে পারছে না। যখন শেষ পর্যন্ত ডিলে গেলেও তা পাবলিক আপরাইজিং তৈরি করল। আল সাদরের সমর্থকরা পার্লামেন্টে ঢুকে বলছে, তারা প্রো ইরানিয়ান মুহাম্মদ আল সুদানিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চায়না, এরা সবাই করাপ্ট লিডার। তারা বলছে, “আমরা মালিকিকে চাইনা, সুদানিকে চাইনা, আমরা এদের কাউকে চাইনা। মালিকি কেন এখনও সরকারে আছে? তাকে সব গুটিয়ে দেশ ছাড়া উচিৎ। জনতা টায়ারড হয়ে গেছে, কলাপ্স করেছে, তারা ক্ষুধার্থ, ড্রাগ নিচ্ছে, তারা ফেড আপ।…”
ইরাকের বর্তমান ১০ মাসের পলিটিকাল ডেডলক তাদের ইতিহাসের দীর্ঘতম বটে, কিন্তু প্রথম নয়। এর আগেও দেশটি প্যারালাইজড হয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২১ সালে ইরাকে বিশাল আন্দোলন হয়েছিল। প্রচুর মার্চ ও ডেমনস্ট্রেশন হয়েছিল, সেই একই কারণেই ঘটেছিল, স্টেট করাপশন, সেক্টেরিয়ানিজম, বেকার সমস্যা, কম বেতন, খারাপ পাবলিক সার্ভিস…। এর আগেও ২০১৬ সালে ইরাকি পার্লামেন্ট দখল হয়েছিল, তখনও আল সাদরের সাপোর্টাররা পার্লামেন্ট দখল করেছিল। তাহলে কেন এটা বারবার ঘটছে? কারণ ইরাক একটি আনস্ট্যাবল দেশ রয়ে গেছে।
আমেরিকার আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞের ১৯ বছর পরও ইরাক এখনও স্থিতিশীল অবস্থায় আসেনি। তাদের ইকোনমি যুদ্ধের আগে সমৃদ্ধ ছিল, এদের বিশাল অয়েল রিজার্ভ ছিল। ৮০ এর দশকে পশ্চিম এশিয়ায় অন্যতম শক্তিশালী ইকোনমি ছিল। রিজার্ভে ছিল ৩৫ বিলিয়ন ডলার। এডুকেশন ছিল অন্যতম সর্বোত্তম। আর্লি ৭০ এর দশকে সকল স্তরে শিক্ষা ফ্রি ছিল, প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ ছিল ১০০%, হেলথ কেয়ারও ছিল ফ্রি। ১৯৯০ সালের আগে ৯৭% আরবান পপুলেশনের ফ্রি প্রাইমারি হেলথ কেয়ারে ফ্রি এক্সেস ছিল, গ্রামে ছিল ৭১%। সাদ্দাম হোসেনের অধীনে ইরাকের ইকোনমিতে সংকট হতে শুরু করে। ৪০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেয়া হয়। কিন্তু এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, দেশটির কলাপ্স ঘটে মূলত ইউএস ইনভ্যাশনের পর। সাদ্দাম সরকারকে উৎখাত করা হয় আর দেশকে লুটপাট করা হয়। যে অর্থ দিয়ে ইরাকিদের সহায়তা দেবার কথা ছিল তা চলে যায় আমেরিকান কোম্পানিগুলোতে। কিভাবে তা হলো? ইরাকের রেভিনিউ এর মেইন সোর্স ছিল অয়েল এক্সপোর্ট। সাদ্দাম সরকারের উৎখাতের পর একটা কনসলিডেটেড ফান্ড তৈরি করা হয়। এর নিয়ন্ত্রণে একটি কোয়ালিশন প্রোভিশনাল অথোরিটি, সিপিএ, একরকম ট্রাঞ্জিশন সরকার, যা ইউএস ও তার এলাই দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। ফান্ডটাকে ইউজ করা হয় ইরাকের রিকনস্ট্রাকশন ফাইনান্সের জন্য। আমেরিকাও রিকনস্ট্রাকশন এফোর্টের কিছু স্পন্সর করে, উদ্দেশ্য ছিল ইরাকিদের রিহ্যাবিলিটেশন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা আমেরিকান কোম্পানিদের হেল্প করে। ৭০টিরও বেশি আমেরিকান কোম্পানি আলাদা আলাদাভাবে ইরাকে রিকনস্ট্রাকশন কন্ট্রাক্ট জেতে, আর এরা পে করে ইরাকের রেভিনিউ থেকে। এটা হয় ইরাকের অকুপেশনের প্রথম বছরে। ইরাকি ফার্ম কয়টা কনট্রাক্ট পেয়েছিল? নেক্সট টু নান। রিকনস্ট্রাকশনে খরচের মাত্র ২% ইরাকিদের হাতে যায়। এদিকে আমেরিকার টপ টেন কন্ট্রাক্টে ৭২ বিলিয়ন ডলার তোলা হয়। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা দেশটিকে ব্যাংকরাপ্ট অবস্থায় ত্যাগ করে, আর মিলিয়ন মানুষ পোভার্টিতে ডুবে যায়। ২০১৮ সালে পোভার্টি রেট ছিল ২০%, গত বছরে তা হয় ৩০%। অন্তত ১২ মিলিয়ন ইরাকিকে আজ দরিদ্র ধরা হয়। তাদের দেশকে একের বেশি উপায়ে লুণ্ঠন করা হয়েছে।
দেশটি তার অনেক কালচরাল ও হিস্টোরিকাল ট্রিজারও হারিয়েছে। ইউএস ইনভ্যাশনের পর মাস লুটিং হয়। হাজার হাজার অ্যান্টিক লুট করা হয়। কিউরেটররা ডেস্পারেটলি ওয়াশিংটনে বারবার অনুরোধ জানিয়ে জানায় এগুলোকে সুরক্ষিত করতে। জানায়, তারা তাদের আর্টিফ্যাক্ট ও মিউজিয়ামকে সুরক্ষিত করতে চায়, কিন্তু তাতে সাড়া দেয়া হয়নি। তখনকার ইউএস ডিফেন্স সেক্রেটারি ডোনাল্ড রুমসফেল্ডকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “stuff happens”। স্টাফ এখনও হ্যাপেনিং… ইরাক এখনও তাদের লস্ট ট্রিজার রিকভার করতে পারেনি। অন্তত ১৫ হাজার আইটেম ইরাকি মিউজিয়াম থেকে নেয়া হয়েছে, এদের ৮০০০ এখনও মিসিং। ইনভ্যাশনের মাধ্যমে ইরাক তার আইডেন্টিটি হারিয়েছে। এখানে এন্ডলেস স্পাইরাল অফ ভায়োলেন্স চলছে। ফালুজ্জায় ক্রিমিনাল গ্যাং এর আক্রমণ হয়েছে। সুন্নি মিলিশিয়া টেরোরিস্ট গ্রুপ আল কায়দা সক্রিয় হয়েছে। এরপর ২০১৪ সালে ডেডলি টেরোরিস্ট গ্রুপ ইসলামিক স্টেটের উত্থান ঘটে। আর এগুলোর সবই ঘটে লিডারশিপ ভ্যাকুয়ামের জন্য। ইউএস এখানে ডেমোক্রেসি ইনস্টল করতে আসে। কিন্তু দেশটি ইকোনমিক ক্রাইসিস, সেক্টেরিয়ানিজম ও ভায়োলেন্স দিয়ে যায়। আর এখন দেশটিতে যে পলিটিকাল ক্রাইসিস চলছে এগুলো তারই ফল…
আপনার মতামত জানানঃ