বাংলাদেশি শ্রমিকদের সমুদ্রপথে বৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই। দেশের আইন অনুযায়ী তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়া তাদের আর কোনো বহির্গমন পথ নেই। প্রতারকচক্র সবকিছু জেনেও সাধারণ মানুষকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে সমুদ্রপথে পাঠানোর নামে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে।
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে যাত্রা করে স্বপ্নের দেশে নোঙ্গর করে না অনেক সমুদ্রযান। দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেক মানুষের জীবন হয় বিপন্ন। টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে মাঝপথেই প্রতারকরা পালিয়ে গেছে, এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে।
অনেক ক্ষেত্রে আটকে রেখে পরিবারের সদস্যদের কাছে দাবি করা হয় মুক্তিপণ। মেটাতে না পারলে চলে অমানুষিক অত্যাচার। অনেককে বিক্রি করে দেয়া হয় দাসশ্রমিক হিসেবে। সম্প্রতি তেমনি এক ঘটনা ঘটেছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার দুর্গাবর্দী এলাকার মনির হাওলাদার ও মুরশিদা বেগম দম্পতির ছেলে তমাল হাওলাদার (১৮)। প্রায় ৯ মাস আগে স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার জন্য দেশ ছেড়েছিলেন তমাল। কিন্তু ইতালি তিনি আর পৌঁছাতে পারেননি। এর আগেই লিবিয়ায় বাংলাদেশি দালালেরা তাকে আটকে রেখে তার মা–বাবার কাছে মুক্তিপণ দাবি করছে। মুক্তিপণের আড়াই লাখ টাকা না দেওয়ায় তার ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।
তারা ছেলেকে রক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। ছেলেকে ফিরে পেতে সরকারের কাছে সহায়তা চাইছেন।
এ বিষয়ে তমালের মা মুরশিদা বেগম বলেন, ‘আমার পোলাডা তিন মাস ধরে বন্দী। দালালেরা কইছিল, কাউরে কিছু কইলে ওরা আমার পোলারে মাইরা ফালাইবে। তাই ভয়ে এত দিন কাউরে কিছু বলি নাই। দফায় দফায় ১৫ লাখ টাকা দিছি। কিন্তু ওরা আমার পোলারে ছাড়ে নাই। এখন তারা (দালালরা) কইতাছে, মুক্তিপণের আড়াই লাখ টাকা দিতে। দুই দিনের মধ্যে টাকা না পাঠাইলে ওরা আমার বাজানরে মাইরা ফালাইবে। লাশের ছবি পাঠাইবে বইলা ঘোষণাও দিছে। এখন আমি কী করুম? কার কাছে যামু? টাকাই বা কই পামু।’
তমালের মতো দালালের প্রলোভনে অবৈধভাবে ইতালি যাত্রা করে দুর্গাবর্দী এলাকার ১৪ তরুণও পড়েছেন মহাবিপদে। বাংলাদেশি দালালেরা মুক্তিপণের জন্য লিবিয়ার বিভিন্ন স্থানে আটকে রেখে তাদের ওপরও ভয়াবহ নির্যাতন চালাচ্ছে।
স্থানীয় ও জনপ্রতিনিধিদের সূত্র জানায়, সদর উপজেলার দুধখালী ইউনিয়নের দুর্গাবর্দী এলাকা থেকে ১৫ জন তরুণ ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে ৯ মাস আগে দেশ ছাড়েন। তারা সবাই এখন লিবিয়ায় বাংলাদেশি দালালদের হাতে বন্দী।
মুরশিদা বেগমদের প্রতিবেশী আলী হোসেন ও নাহার বেগম দম্পতির ছেলে ইমন ব্যাপারীকেও (১৯) লিবিয়া মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করছে দালালেরা। ইমনে মা নাহার বেগম বলেন, ‘দালাল গো তিন দফায় ১৫ লাখ টাকা দিছি। এরপরেও আমার পোলারে বিক্রি করে দিছে।
সন্তানদের নিরাপত্তার ভয়ে দালালদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করতে চান না।
লিবিয়ায় বিভিন্ন স্থানে বন্দী থাকা ওই তরুণদের স্বজনেরা বলেন, দালাল চক্রের নেতৃত্বে আছেন দুর্গাবর্দী এলাকার নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী নাজমিন আক্তার। এই দম্পতির দুই ছেলে থাকেন ইতালি।
নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী নাজমিন আক্তার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।
মাদারীপুর সদর মডেল থানার ওসি মনোয়ার হোসেন চৌধুরী পবলেন, ‘সন্তানদের নিরাপত্তার ভয়ে দালালদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করতে চান না। এ বিষয়ে নির্যাতনের শিকার তরুণের পরিবারগুলোর কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নেব।’
প্রথম আলো জানায়, প্রথমে বিদেশে যেতে ইচ্ছুক মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকার তরুণদের টার্গেট করে দালাল চক্র। এরপর দালাল চক্রের সদস্যরা ওই তরুণদের মা–বাবার কাছে গিয়ে ইতালি পাঠানোর জন্য সাত–আট লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করে। এরপর ওই টাকা নিয়ে তারা তরুণের ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে প্রথমে লিবিয়া নিয়ে যায়। সেখানে থাকা বাংলাদেশি দালালদের একটি চক্র তাদের আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করে। কিন্তু একবার, দুবার এমনকি অনেক সময় তিনবার মুক্তিপণের টাকা দিলেও অনেকে মুক্তি পান না। কেউ কেউ সব মিলিয়ে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা খরচ করার পরও মুক্তি পাচ্ছেন না।
প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হয় দালালের হাত ধরে ইতালি ও স্পেন প্রবেশের চেষ্টায় ভূমধ্যসাগরে ডুবে শত শত অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু। খবর আসে, আমেরিকায় যাওয়ার পথে বনে-জঙ্গলে দালালের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। ইউরোপে ঢোকার আশায় বলকানের বরফঢাকা জঙ্গলে হাজারো মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে অপেক্ষায় থাকার সংবাদও আসে।
ভালো পারিশ্রমিকের আশায় কয়েক বছর ধরে পাচারকারীদের সহায়তায় লিবিয়া যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। সেখান থেকেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশি। এরপরও ঝুঁকিপূর্ণ এ প্রবণতা বন্ধ হয়নি। এ ছাড়া প্রতারণার শিকার হয়ে লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের হাতে বহু বাংলাদেশি আছেন আটক অবস্থায়।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের তালিকায় শীর্ষে আছে বাংলাদেশ।
মানব পাচারের দিক থেকে আন্তজার্তিক সংস্থার তালিকাতে কেন বাংলাদেশ শীর্ষে? আমরা যদি এর কারণ খুঁজি তাহলে সর্বপ্রথম যে কারণটি আসবে তা হলো বেকারত্ব। দেশের বিপুল পরিমাণ বেকার ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ধারণা, বিদেশে গেলে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে। পারিবারিক সচ্ছলতা আসবে এই বিশ্বাস নিয়ে অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় তারা। তাদের এই বিশ্বাসকে পুঁজি করে স্বার্থ হাসিল করে পাচারকারীরা।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের সূত্র মতে কক্সবাজার ও টেকনাফের ৮০টি পয়েন্ট দিয়ে মানব পাচার হয়। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার জন্য জন্য মানব পাচার কমানো যাচ্ছে না। মানব পাচারকারী চক্রের সাথে পুলিশ, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নেতাসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার হাত আছে বলে মনে করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানব পাচারের আরো একটি কারণ হলো অসচেতনতা। পাচার হওয়া ভিক্টিম যারা ফিরে আসে তাদের নিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম বা ভিক্টিমদের বক্তব্য, তাদের দুর্দশার কথাগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের সহজ সরল মানুষের মাঝে তুলে ধরার মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে। যে এলাকা থেকে মানব পাচার বেশি হচ্ছে সেই এলাকা চিহ্নিত করে সচেতন করা। বেকারত্ব কমাতে যুবক ও মহিলাদের কারিগরি শিক্ষা বৃদ্ধি করে নিজ দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। জনশক্তি রপ্তানিতে সরকারি কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে উন্নত দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বাড়ানো। এছাড়া উপকূল ও সীমান্ত এলাকাতে পর্যাপ্ত কোস্ট গার্ড ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে হবে। সমুদ্রসীমা সুরক্ষার জন্য আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন দরকার বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৬
আপনার মতামত জানানঃ