বাংলাদেশে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমছে। গত কয়েক বছরে শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি দেশে কনস্টেবল থেকে শুরু করে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এসব অপরাধ ও অপকর্মের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বে অবহেলা ও ঘুষ গ্রহণ ছাড়াও চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, এমনকি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার মতো ঘৃণ্য অপরাধও আছে।
বগুড়ার ধুনট উপজেলায় একটি ধর্ষণ মামলার আলামত নষ্ট করার অভিযোগে উঠেছে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ধুনট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কৃপা সিন্ধু বালার বিরুদ্ধে। বাদী ওসির বিরুদ্ধে আলামত নষ্টের অভিযোগ এনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বগুড়ার পুলিশ সুপারের (এসপি) কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।
অভিযোগটি আমলে নিয়ে ওসিকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এ অভিযোগ তদন্তে আগে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবদুল রশিদকে এর প্রধান করা হয়েছে।
বর্তমানে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি)। গত বৃহস্পতিবার মামলার তদন্তভার ডিবিকে বুঝিয়ে দিয়েছেন ওসি কৃপা সিন্ধু বালা। বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়,মামলা সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার জালশুকা হাবিবর রহমান ডিগ্রি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের শিক্ষক মুরাদুজ্জামান ওরফে মুকুলকে (৪৮) গত বছরের অক্টোবরে ধুনট উপজেলার একটি এলাকায় বাসা ভাড়া নেন। সেখানে তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। ওই বাসার মালিকের মেয়ে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। ওই ছাত্রীর মা-বাবা পেশাগত কারণে বেশির ভাগ সময় বাসার বাইরে থাকেন। ওই শিক্ষকের স্ত্রীও কর্মসূত্রে দিনে বাইরে থাকেন। এই সুযোগে মুরাদুজ্জামান একদিন কৌশলে ওই স্কুলছাত্রীকে জড়িয়ে ধরে মুঠোফোনে ছবি তোলেন। এরপর ওই ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাকে কয়েকবার ধর্ষণ করেন।
১২ মে আবারও ধর্ষণের চেষ্টা করলে ওই ছাত্রী চিৎকারে দেয়। এ সময় স্বজনেরা ছুটে হলে মুরাদুজ্জামান পালিয়ে যান। এরপর ওই ছাত্রীর কিছু অশালীন ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন মুরাদুজ্জামান। পরে ওই ছাত্রীর মা বাদী হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে গত ১২ মে ধুনট থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। ওই মামলায় পুলিশ মুরাদুজ্জামানকে গ্রেপ্তার ও অশালীন ভিডিও ধারণ করা মুঠোফোন জব্দ করে। মুরাদুজ্জামান বর্তমানে বগুড়া কারাগারে আছেন।
বাদীর লিখিত অভিযোগে থেকে জানা যায়, মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ধুনট থানার ওসি কৃপা সিন্ধু বালা নিজেই। ১৮ মে আসামি মুরাদুজ্জামানকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর হেফাজত থেকে আরও একটি মুঠোফোন জব্দ করা হয়। ওই মুঠোফোনে পাওয়া কয়েকটি অশালীন ভিডিও ক্লিপ সিডিতে কপি করে নেন ওসি। এসব সিডি ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডিতে পাঠানোর কথা।
আসামিপক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে ওসি কৃপা সিন্ধু বালা মামলার আলামত নষ্ট করান। গত ১৯ মে জব্দ করা মুঠোফোন দুটি তিনি আদমদীঘি থানার একজন উপপরিদর্শকের কাছে পাঠিয়ে ফোনে থাকা সব ভিডিও ক্লিপ ও তথ্য মুছে ফেলা হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
সিডিগুলো না পাঠিয়ে শুধু উদ্ধার হওয়া দুটি মুঠোফোন সিআইডিতে পাঠিয়েছেন। আসামিপক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে ওসি কৃপা সিন্ধু বালা মামলার আলামত নষ্ট করান। গত ১৯ মে জব্দ করা মুঠোফোন দুটি তিনি আদমদীঘি থানার একজন উপপরিদর্শকের কাছে পাঠিয়ে ফোনে থাকা সব ভিডিও ক্লিপ ও তথ্য মুছে ফেলা হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
জানতে চাইলে ধুনট থানার ওসি কৃপা সিন্ধু বালা বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। মামলাটির তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল। মুঠোফোন দুটি ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডিতে পাঠানোও হয়েছে। এরপরও তদন্ত যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়—সে জন্য পুলিশ সুপারের নির্দেশে তদন্তভার ডিবির কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সোমবার সন্ধ্যায় বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ২ আগস্ট ওসির বিরুদ্ধে মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা মুঠোফোন থেকে ধর্ষণের ভিডিও চিত্র অন্যকে দেখানো এবং মুছে ফেলার অভিযোগ আনেন মামলার বাদী। অভিযোগটি আমলে নিয়ে মামলার তদন্ত কার্যক্রম থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি করা হয়েছে জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, জব্দ করা মুঠোফোনে ধর্ষণের ভিডিও চিত্র ছিল কি না, তা ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদর দপ্তরের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে। ফরেনসিক পরীক্ষা ও তদন্তে মুঠোফোনে ধর্ষণের ভিডিও ধারণের প্রমাণ পাওয়া গেলে আসামির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় আরও মামলা হবে। এ ছাড়া মুঠোফোন থেকে ভিডিও মুছে ফেলার দায়ে ওসির বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনালে ৬ মাসের মধ্যে এসব মামলার বিচার শেষ করার বিধান আছে৷ কিন্তু নানা অজুহাতে তা শেষ হয় না৷ অর্থ ও ক্ষমতার কারণে কিছু অসৎ পুলিশও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে গড়িমসি করে। আবার মামলা নিলেও তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে টালবাহানা করে। কখনো টাকার বিনিময়ে অপরাধীদের বাঁচিয়ে প্রতিবেদন দিতে চেষ্টা করে দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ। কিংবা অপরাধী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের না দেখার ভান করে।
একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর পুলিশের যথাসময়ে সঠিক ধারায় মামলা গ্রহণ, ধর্ষক ও ধর্ষিতার সঠিক বয়স উল্লেখ, মামলার সুষ্ঠু তদন্ত, চিকিৎসকের নির্ভুল ময়নাতদন্ত, যথাযথ ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলের ওপর পুরো বিচার প্রক্রিয়া নির্ভরশীল। এর ভিন্নতা হলে ধর্ষক বিচারে আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। কাজেই ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর ঘটনায় অপরাধী যাতে উপযুক্ত শাস্তি পায় এর নিশ্চয়তা বিধান মামলার বিচার সংশ্লিষ্টদের মানবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১০২০
আপনার মতামত জানানঃ