সংবাদপত্রকে বলা হয় একটা দেশের দর্পণ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সংবাদপত্র চেক এন্ড ব্যালেন্সের কাজ করে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই আমাদের সংবিধানে ব্যাপারে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু এই মহাজোট সরকার আসার পর বিভিন্ন সময় এরা সংবাদকর্মীদের উপর চড়াও হয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগ ছিলো এসব ব্যাপারে বেপরোয়া। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করায় বা করার জন্য সংবাদ সংগ্রহের উদ্যোগ নিলেই ছাত্রলীগ বিভিন্ন সময় তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বড় বড় প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে তারা সাংবাদিকদের মারধর, লাঞ্চিত, ক্যামেরা ভাংচুর, এমন কি হত্যাও করেছে।
ছাত্রলীগ কর্তৃক সাংবাদিক নির্যাতন ও লাঞ্ছিতের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সাংবাদিক নির্যাতনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা।
চট্টগ্রাম নগরীতে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হামলা শিকার হয়েছেন দৈনিক ভোরের কাগজ চট্টগ্রাম অফিসের স্টাফ রিপোর্টার প্রীতম দাশ।
শনিবার (১৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় নগরীর নিউমার্কেট মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। হামলার পর তাকে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার এক্স–রে ও সিটিস্ক্যান করানোর পর তার চিকিৎসা চলছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, বোয়ালখালীর স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজে শিক্ষক সংকটসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের দাবিতে সকালে কলেজের সামনে ছাত্র ইউনিয়ন মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। ওই সমাবেশে একপর্যায়ে অতর্কিত হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
পরে এই ঘটনার প্রতিবাদে বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় কর্মসূচি দেয় জেলা ছাত্র ইউনিয়ন। সেখানেও দ্বিতীয় দফা হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এই ঘটনায় ভোরের কাগজ চট্টগ্রাম অফিসের প্রতিবেদক প্রীতম দাশ আহত হন।
স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজে ফরম-ফিলাপসহ ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি চলছিল। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নেরও একটি সমাবেশ ছিল। সাংবাদিক প্রীতম দাশ পেশাগত দায়িত্বপালন করলে তাকে বেদম মারধর করা হয়। পরে প্রতিবাদ সভা হলে সেখানেও তাকে মারধর করে ফেলে রাখে।
সমাবেশের শেষদিকে হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনে ভোরের কাগজ পত্রিকার সাংবাদিক প্রীতম দাশ দূর থেকে একটি ছবি তোলেন। সেখানে ছাত্রলীগের কয়েকজন ‘প্রতিবন্ধীর’ ওপর হামলা চালাতে দেখে বাঁচাতে এগিয়ে যান সাংবাদিক প্রীতম দাশ। আর তখনই হামলার শিকার হন তিনি। এ সময় মূহূর্তেই সিটি কলেজের ৪০-৫০ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী হামলায় অংশ নেন।
হামলায় তার বুকে, মাথায়, হাঁটু ও পিঠে আঘাত করেছে হামলাকারীরা। এ ঘটনার সাংবাদিকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন জায়গায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে প্রীতম দাশ বলেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই অতর্কিতভাবে হামলার শিকার হই। সেখানে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলাম আমি। আমাকে পেয়ে বুকে, মাথায়, হাঁটু, পেটে ও পিঠে লাঠিসোঁটা দিয়ে মারতে শুরু করে তারা।
পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ষষ্ঠ তলায় ৬৩৫ নং রুমে চিকিৎসা নেন তিনি। সেখানে তার এক্স-রে ও সিটিস্ক্যান করা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে বাসায় পাঠিয়ে দেবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘটনায় উপস্থিত এক সাংবাদিক বলেন, স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজে ফরম-ফিলাপসহ ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি চলছিল। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নেরও একটি সমাবেশ ছিল। সাংবাদিক প্রীতম দাশ পেশাগত দায়িত্বপালন করলে তাকে বেদম মারধর করা হয়। পরে প্রতিবাদ সভা হলে সেখানেও তাকে মারধর করে ফেলে রাখে।
এদিকে এ ঘটনায় চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। বিতর্ক যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পাশাপাশি ভিন্নমতের ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে তারা। ছাত্রলীগ নেতাদের বেপরোয়া হয়ে ওঠার কারণেই সাংবাদিক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কেউ তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। দলীয় প্রভাব খাটিয়েই ছাত্রলীগ নেতারা এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। সরকার দলীয় বিধায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে কেউ সাহস করে না। এমনকি প্রশাসনও কোনো ভূমিকা নিতে পারে না। এসবের শাস্তি নিরূপণ নয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণের বেড়ে যাওয়ায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এ পেশার অনেকেই। আইনের দীর্ঘসূত্রিতা, জটিল বিচারিক প্রক্রিয়া সেইসঙ্গে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান পক্ষ থেকে কোন ধরণের সহযোগিতা না থাকার কারণে সাংবাদিক নির্যাতন ও সহিংসতা থামানো যাচ্ছেনা। সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় কোন প্ল্যাটফর্ম না থাকায় এই পেশা দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে বলেও মন্তব্য করেন তারা।
তারা বলেন, সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হলেও সেগুলো আদালতে নিতে চান না। কেননা মামলা করতে গেলে প্রতিষ্ঠান থেকে যে সাপোর্ট লাগে বা অর্থনৈতিকভাবে যে সাপোর্ট লাগে, সেটা তাদের সবার থাকেনা। এ অবস্থায় বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায়। বাংলাদেশের সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও রাষ্ট্রীয় সামাজিকভাবে সেই স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়নি বলে জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৪
আপনার মতামত জানানঃ