আমাদের মস্তিষ্ক এবং আমাদের স্মার্টফোনগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল। ২০০০ সাল থেকে মানুষের জীবনে স্মার্টফোনের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে মহামারী করোনার সময় ব্যাপক হারে তা বেড়েছে, অধিকাংশ মানুষই সাধারণত ইন্টারনেট সময় কাটিয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী চাপ, বিচ্ছিন্নতা, ক্লান্তি এবং বিষন্নতা; ২০২০ সালের মার্চ থেকে খুব সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া স্মৃতিশক্তিতেও এর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। ২০২১ সালে স্মৃতিশক্তি গবেষক ক্যাথরিন লাভডের জরিপে দেখা যায়, জরিপে অংশ নেয়া ৮০ শতাংশ মানুষ মনে করেছিল যে, তাদের স্মৃতিশক্তি মহামারীর পর আরও খারাপ হয়ে গেছে। চলুন এ বিষয়ে বিশদে জেনে নেওয়া যাক।
কমে যাচ্ছে মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থ
অধ্যাপক অলিভার হার্ড, যিনি মন্ট্রিলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে ‘স্মৃতিশক্তি এবং ভুলে যাওয়ার’ স্নায়ুবিজ্ঞান নিয়ে অধ্যয়ন করেন, তিনি জিপিএসের উপর আমাদের নির্ভরতার বিষয়ে আগ্রহী নন। তিনি বলেন, “আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি, জিপিএসের দীর্ঘ ব্যবহার সম্ভবত মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাসে ধূসর পদার্থের (গ্রে ম্যাটার) ঘনত্ব কামিয়ে দিবে। মস্তিষ্কের এই অঞ্চলে ধূসর পদার্থের ঘনত্ব কমে যাওয়ার বিভিন্ন উপসর্গ দেখা যায় বিষণ্নতা এবং অন্যান্য মনোরোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে, এছাড়া বিভিন্ন প্রকারের ডিমেনশিয়াও এর কারণ।
জিপিএসভিত্তিক ন্যাভিগেশনাল সিস্টেমগুলোর জন্য আপনাকে জটিল ভৌগলিক মানচিত্র মনে রাখতে হবে না। এর পরিবর্তে এটি শুধু আপনাকে নির্দেশ দিবে, যেমন “ট্রাফিক লাইটের কাছে, বাম দিকে ঘুরুন।” এগুলো খুব সাধারণ আচরণগত প্রতিক্রিয়া (এখানে: ট্রাফিক লাইট, বাম দিকে ঘুরুন)। এই ধরনের আচরণ হিপ্পোক্যাম্পাসকে খুব বেশি কাজে লাগায় না। ফলে সেই মানচিত্রের সেই জটিল স্থানগুলো স্মরণে রাখতে মস্তিষ্ককে ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। আর তাই যারা অনেক দিন ধরে জিপিএস ব্যবহার করছেন তাদের জায়গা চেনা ও মনে রাখার ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। মানচিত্র মনে রাখা কঠিন এবং সেজন্যই আমরা ডিভাইসের মাধ্যমে সহজেই তা বের করে থাকি। তবে কঠিন জিনিসগুলো আপনার জন্য মস্তিষ্কের জন্য ভাল। কারণ এগুলো কগনিটিভ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলকে ব্যবহার করে।”
বৃদ্ধি পাচ্ছে ডিমেনশিয়া
প্রফেসর হার্ডের কাছে এখনও নির্দিষ্ট ডেটা বা তথ্য নেই। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, “ডিমেনশিয়া বৃদ্ধির একটি বিশাল কারণ হতে পারে এটা। আপনি আপনার মনকে যত কম ব্যবহার করবেন, আপনার মস্তিষ্কে জটিল জিনিসগুলো ধারণ করার সিস্টেমগুলো (এপিসোডিক মেমরি) তত কম ব্যবহৃত হবে, ফলে ডিমেনশিয়া হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি হবে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি যখন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন তাহলে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়া সত্যিই কঠিন। এবং এর কারণ এই নয় যে এই লোকেরা অধিক বুদ্ধিমান। এর পেছনের কারণ হলো বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তারা অভ্যাসগতভাবেই এমন সব কাজে নিয়োজিত থাকেন যাতে মানসিকভাবে খুব বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়।” (অন্যান্য বিজ্ঞানীরা অবশ্য তার সাথে একমত নন। যেমন হার্ভার্ড মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল শ্যাক্টার, যিনি ‘সেভেন সিনস অফ মেমোরি: হাউ দ্য মাইন্ড ফরগেটস অ্যান্ড রিমেম্বার্স’ বইয়ের লেখক, তিনি মনে করেন, জিপিএস-এর মতো জিনিসগুলোর প্রভাব তেমন নয়।)
স্মার্টফোনগুলো স্পষ্টতই জ্ঞানের সম্পূর্ণ নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। কিন্ত এগুলো আমাদেরকে বর্তমান মুহূর্ত থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। যেমন আজকে একটি সুন্দর দিন, আপনি জানেন না কারণ আপনি মাথা নিচু করে আছেন, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজিং করছেন। আমরা যখন কোনো অভিজ্ঞতা অর্জন করি না, তখন সেটিকে আর সম্পদ বলা যায় না। আমাদের কম অভিজ্ঞতা অর্জন সৃজনশীল হওয়ার ও মনে রাখার ক্ষমতাকেও কমিয়ে দেয়।
প্রখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং স্মৃতি গবেষক ওয়েন্ডি সুজুকি সম্প্রতি হুবারম্যান ল্যাব নিউরোসাইন্স পডকাস্টে বলেছেন, “আমরা কী করেছি, আমরা যে তথ্য শিখেছি এবং আমাদের জীবনের ঘটনাগুলো যদি আমরা মনে রাখতে না পারি, তাহলে তা আমাদের মস্তিষ্ককে পরিবর্তন করে দেয়।”
স্মার্টফোনগুলো স্পষ্টতই জ্ঞানের সম্পূর্ণ নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। কিন্ত এগুলো আমাদেরকে বর্তমান মুহূর্ত থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। যেমন আজকে একটি সুন্দর দিন, আপনি জানেন না কারণ আপনি মাথা নিচু করে আছেন, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজিং করছেন। আমরা যখন কোনো অভিজ্ঞতা অর্জন করি না, তখন সেটিকে আর সম্পদ বলা যায় না। আমাদের কম অভিজ্ঞতা অর্জন সৃজনশীল হওয়ার ও মনে রাখার ক্ষমতাকেও কমিয়ে দেয়।
মস্তিষ্ককে পরিবর্তন করে ফেলছে স্মার্টফোন
ক্যাথরিন প্রাইস, বিজ্ঞান লেখক এবং “হাউ টু ব্রেক আপ উইথ ইওর ফোন” বইয়ের লেখক সহমত প্রকাশ করে বলেন, “আমরা প্রতি মুহূর্তে যেসব কিছুতে মনোযোগ দিই তা আমাদের জীবনে যোগ হয়।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের মস্তিষ্ক একসাথে একাধিক কাজ (মাল্টিটাস্ক) করতে পারে না। যখন আমরা একসাথে একাধিক কোনো কাজে সফল হই তখন আসলে এই কাজগুলোর মধ্যে একটি কাজে মনোযোগ দেয়া হয়নি। যেমন আপনি লন্ড্রি ভাঁজ করতে রেডিও শুনতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি আপনার ফোনে মনোযোগ দেন তবে আপনি অন্য কিছুতে মনোযোগ দিচ্ছেন না। এটিকে একটি দূর্বল পর্যবেক্ষণের মতো মনে হতে পারে তবে এটি আসলে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। কারণ আপনি কেবল সেই জিনিসগুলো মনে রাখতে পারবে যেগুলোতে আপনি মনোযোগ দেবেন। আপনি যদি মনোযোগ না দেন, তাহলে আপনার মনে রাখার মতো স্মৃতি থাকবে না।
কেমব্রিজের স্নায়ুবিজ্ঞানী বারবারা সাহাকিয়ানের কাছেও এর প্রমাণ রয়েছে। ২০১০ সালের একটি পরীক্ষায় তিনটি দলকে পড়ার একটি কাজ দিয়েছিলেন তিনি। স্নায়ুবিজ্ঞানী জানান, এর মধ্যে একটি দলকে পরীক্ষা শুরু করার আগে তাৎক্ষণিক মেসেজ দিয়েছিল, আরেকটি দল পরীক্ষা চলাকালীন সময় মেসেজ পেয়েছিল এবং একটি দল কোনো মেসেজই পায়নি। এরপরে তারা একটি বুদ্ধির পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে দেখা গেছে, যে লোকেরা তাৎক্ষণিক মেসেজ পেয়েছে তারা একটু আগেই যা পড়েছে তা মনে রাখতে পারছেন না না।”
বর্তমানে চলমান এবিসিডি গবেষণা অনুযায়ী, স্মার্টফোন ব্যবহার মস্তিষ্ককে পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। যেটিতে ১০ হাজার আমেরিকান শিশুকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত পরীক্ষা করেছে। এই পরীক্ষার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফলাফলগুলোর মধ্যে একটি ছিল; যে শিশুরা প্রযুক্তির ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্কের কর্টিকাল পাতলা হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানী ল্যারি রোজেন বলেন, অল্পবয়স্ক শিশুরা যারা বেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের একটি কর্টেক্স পাতলা ছিল, এরকমটা আরও বড় হওয়ার পর ঘটার কথা। বয়স বৃদ্ধি পেলে এবং বৃদ্ধ হলে কর্টিকাল পাতলা হয় এবং পরবর্তী জীবনে পারকিনসন এবং আলঝেইমারের মতো স্মৃতি বিভ্রম রোগের পাশাপাশি মাইগ্রেনের কারণও হতে।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দূরদৃষ্টি অর্জনের ক্ষমতা
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ লিন্ডা স্টোনের মতে, স্মার্টফোনের মাধ্যমে আমাদের মনোযোগ হারানো বা কোনো কিছুতে মনোযোগের ঘাটতি অনেক উদ্বেগজনক একটি ব্যাপার। তিনি বলেন, “আমি আমার ঠিকানার বইয়ের (এড্রেস বই) মাধ্যমে মনোযোগ হারাই না। তিনি এটি বিশ্বাস করেন না যে স্মার্টফোন আমাদের আরও ভালো কিছু করার সুযোগ তৈরি করে দেয়।
তিনি বলেন “বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের আমলে টুইটার থাকলে কী হতো? তিনি কি সব সময় টুইটারে থাকতেন? তিনি কি তার এত আবিষ্কার এবং সফলতা অর্জন করতে পারতেন? এটা নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব নয়। কারণ স্মার্টফোন চালু হওয়ার আগে কেউ আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতার মাত্রা পরিমাপ করেনি। কিন্তু স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের দূরদৃষ্টি অর্জনের ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আপনি একজন অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ হতে পারবেন না যদি আপনার মস্তিষ্কে যথেষ্ট উপাদান না থাকে। (তার তত্ত্বটি ৯২ বছর বয়সী নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নিউরোসাইন্টিস্ট এবং বায়োকেমিস্ট এরিক ক্যান্ডেল সমর্থন করেছিলেন, যিনি অধ্যয়ন করেছেন কীভাবে মনোযোগহীনতা স্মৃতিশক্তিকে প্রভাবিত করে।)
অস্থিরতা ও অমনোযোগীতা আমাদের স্মৃতশক্তিকে প্রভাবিত করে এবং স্মৃতিগুলোর সমন্বয় সাধনে ব্যর্থ হয়। সাইকোলজিস্ট প্রফেসর ল্যারি রোজেন বলেন, স্মার্টফোনগুলো অবশ্যই আমাদের মনোযোগ কেড়ে নেয়ার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। আমাদের মনোযোগ কেড়ে নিয়ে অর্থ উপার্জনকারী অ্যাপগুলো আসলে আমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্যই ডিজাইন করা হয়েছে।
লেখক ক্যারথরিন প্রাইস বলেন, আমি বিজ্ঞপ্তি ও নোটিফিকেশনগুলোকে বাধা হিসেবে মনে করি কারণ এগুলো সেটাই করছে। মানুষ একটি খুব দুর্বল প্রাণী এবং আমরা বিলুপ্ত না হওয়ার একমাত্র কারণ হল আমাদের একটি উচ্চতর মস্তিষ্ক রয়েছে: যা আমাদের ধ্বংস হওয়া এড়াতে এবং খাদ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ