১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে, নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ও আরও দুটি শহরে যে অভাবিত সন্ত্রাসী হামলা হয়, এই দেশের মানসিক মানচিত্রে তা এক গভীর দাগ ফেলে গেছে। সেই ঘটনার সূত্রে আফগানিস্তান ও ইরাকে দুটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা। অনেকের বিশ্বাস, বিশ্বজুড়ে যে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে, তা এই দুই যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
৯/১১-এর ঘটনার ফলে আমেরিকার ভেতরে মুসলিম-বিদ্বেষী যে মনোভাবের জন্ম হয়, তা-ও পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে এসবের বাড়বাড়ন্ত লক্ষ করা গেছে।
রয়টার্সের এক খবরে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে বড় শহর আলবুকার্কে গত নয় মাসে তিন মুসলিমকে খুনের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় একই যোগসূত্র থাকতে পারে এবং ধর্ম ও জাতিগত পরিচয়ের কারণে তাদের হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছে পুলিশ।
গত ১০ দিনে আলবুকার্কের একই মসজিদের দুই মুসল্লিকে হত্যা করা হয়। নগর পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, নভেম্বরে আফগান অভিবাসী হত্যার ঘটনার সঙ্গে তাদের নিহত হওয়ার যোগসূত্র থাকার ‘প্রবল সম্ভাবনা’ রয়েছে।
নগর পুলিশ জানায়, ভুক্তভোগী তিনজনই অতর্কিত হামলার শিকার হন এবং কোনো ধরনের হুঁশিয়ারি দেওয়া ছাড়াই তাদের গুলি করা হয়।
নিউ মেক্সিকোর পত্রিকা ‘সান্টা ফে’র প্রতিবেদন অনুযায়ী আলবুকার্ক পুলিশের ডেপুটি কমান্ডার কাইল হার্টসক স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আমাদের তিন ভুক্তভোগীর খুবই একটি সাধারণ মিল আছে—তাদের জাতিগত পরিচয় ও ধর্ম।’
পুলিশ জানায়, মুহাম্মদ আফজাল হোসাইনকে গত সোমবার আলবুকার্কে তার অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়। এস্পানিয়লা শহরের ২৭ বছর বয়সী এই পরিকল্পনা পরিচালক পাকিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন।
এর আগে আলবুকার্কের বৃহৎ আফগান সম্প্রদায়ের সদস্য আফতাব হোসেনকে হত্যা করা হয়। গত ২৬ জুলাই শহরের আন্তর্জাতিক জেলার কাছে ৪১ বছর বয়সী এই ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ মরদেহ পাওয়া যায়।
হার্টসক বলেন, এই দুটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে গত ৭ নভেম্বর একটি হালাল সুপার মার্কেট ও ক্যাফের পার্কিংয়ের জায়গায় ৬২ বছর বয়সী মোহাম্মদ আহমাদিকে গুলি করে হত্যার যোগসূত্র থাকতে পারে।
‘সান্টা ফে’-কে নিউ মেক্সিকোর ইসলামিক সেন্টারের মুখপাত্র তাহির গাউবা বলেন, ‘আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে আমরা কখনো এমন আতঙ্ক বোধ করিনি।’
এ সব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিবর্গকে গ্রেপ্তার ও আইনে আওতায় আনতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করলে পাঁচ হাজার ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে বলে গতকাল শুক্রবার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মুসলিম মানবাধিকার সংগঠন কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর)।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে একটি মসজিদে এশার নামাজের সময় মুসল্লিদের ওপর পাথর নিক্ষেপ করেছে দুর্বৃত্তরা। এসময় অন্তত দুজনের পায়ে আঘাত লাগে। গত সপ্তাহের ওই ঘটনার পর থেকে আতঙ্ক বিরাজ করছে স্থানীয় মুসল্লিদের মধ্যে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে একটি মসজিদে এশার নামাজের সময় মুসল্লিদের ওপর পাথর নিক্ষেপ করেছে দুর্বৃত্তরা। এসময় অন্তত দুজনের পায়ে আঘাত লাগে। গত সপ্তাহের ওই ঘটনার পর থেকে আতঙ্ক বিরাজ করছে স্থানীয় মুসল্লিদের মধ্যে।
তুর্কি সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড জানিয়েছে, সাত বছর আগে চালু হওয়া মসজিদটিতে প্রধানত বাঙালি মুসল্লিরা নামাজ আদায় করেন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজের খবরে বলা হয়েছে, গত সোমবার (১ আগস্ট) নিউ জার্সির প্যাটারসন শহরের আবু বকর ইসলামিক কংগ্রেগেশন মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর পাথর নিক্ষেপ করে মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা। এরপর থেকেই আতঙ্কে রয়েছেন মুসল্লিরা। এখন নামাজ শুরু হয়ে গেলে আর কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
মসজিদের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সাজ্জাদ চৌধুরী জানান, সোমবার স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৮টার দিকে নামাজ শুরু হয়ে গেলে দুই ব্যক্তি মসজিদে ঢোকেন। তারা আসসালামু ওয়ালাইকুম বলে অনুরোধ জানায়, তাদের যেন ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়।
কিন্তু ভিডিওতে দেখা যায়, ভেতরে ঢুকেই নামাজরত মুসল্লিদের ওপর পেছন থেকে পাথর ছুড়ে মারে দুই দুর্বৃত্ত। এসময় তৃতীয় আরেক ব্যক্তি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। পরে তারা তিনজনই দৌড়ে পালিয়ে যায়।
সাজ্জাদ জানান, কয়েক মিনিট পরে ওই লোকগুলো ফিরে এসে আবার মুসল্লিদের দিকে পাথর ছোড়ে। এতে দুজনের পায়ে আঘাত লাগে। তবে কেউ আহত হননি। তিনি বলেন, আমরা খুব আতঙ্কিতবোধ করছি।
জাহসিন ইউদ্দীন নামে আরেক সদস্য বলেন, আমরা কাউকে বিরক্ত করিনি এবং আমি জানি না কেন মানুষ এমন করে। সবারই ধর্মীয় রীতি পালনের অধিকার রয়েছে।
প্যাটারসনের মেয়র আন্দ্রে সায়েগ বলেছেন, তারা (মুসলিমরা) শান্তির জন্য প্রার্থনা করছে। তাদের সহিংসতার মুখে পড়া উচিত নয়।
এ ঘটনার মাত্র আট মাস আগে মুসল্লিদের ওপর হামলার অভিযোগে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মসজিদ থেকে আজানের শব্দ নিয়ে অভিযোগ ছিল তার।
কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস জানিয়েছে, নিউ জার্সিতে এ বছর প্রায় ১০০টি পক্ষপাতমূলক ভীতিপ্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছে। হামলা থেকে বাঁচতে মার্কিন অঙ্গরাজ্যটির মসজিদগুলোতে বুলেটপ্রুফ জানালা বসানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বেশিরভাগ মুসলমানই ইসলাম বিদ্বেষী অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের ওপর চালানো এক জরিপেও এমন তথ্য ওঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আদারিং অ্যান্ড বিলোংগিং ইনস্টিটিউটের পরিচালিত এই জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৬৭.৫ ভাগ অংশগ্রহণকারী জানান, তারা কথিত ইসলামোফোবিয়ামূলক মৌখিক ও শারীরিক হামলা এবং বৈষম্যমূলক নীতির শিকার হয়েছেন।
মোট এক হাজার ১২৩ অংশগ্রহণকারী এই জরিপে অংশ নেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নারীদের ৭৬.৭ ভাগ জানান, তারা ইসলামোফোবিয়ার শিকার হয়েছেন। অপরদিকে পুরুষদের মধ্যে ৫৮.৬ ভাগ পুরুষ ইসলামোফোবিয়ার শিকার হয়েছেন। অন্য যেকোনো বয়সীদের তুলনায় ১৮-২৯ বছর বয়সীরাই বেশি ইসলামোফোবিয়ামূলক অপরাধের শিকার হন বলে জরিপে তথ্য প্রকাশ করা হয়।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১৮-২৯ বছর বয়সী তরুণরা বলেন, এই পরিস্থিতি এড়াতে তারা নিজেদের ধর্ম গোপন করেন। জরিপে অংশ নেওয়া ৯৩.৭ ভাগ জানান, ইসলামোফোবিয়া ও মুসলিমবিদ্বেষ তাদের মানসিক অবস্থা ও মনস্তত্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে।
এ অবস্থায় ধর্মীয়ভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণে ও তাদের বর্ণবাদের শিকার বানানোয় যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যে ক্ষতি হয়েছে, তা আমাদের নানা বিতর্ক ও আলাপে তুলে ধরতে হবে। সেটি করতে পারলেই আমেরিকান ইসলামভীতি দূর হবে।
ধর্মীয় পরিচয়ভিত্তিক সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথম নয়। এর আগে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান, আদিবাসী আমেরিকান এবং অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘু এই ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিক স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করার ইতিহাস বহু পুরনো। শতাব্দী আগে ভুক্তভোগী ছিল ইহুদি ও ক্যাথলিকরা। বর্তমানে লক্ষ্যবস্তু মুসলমানরা। দুই দশক ধরে মিডিয়া আমেরিকানদের মধ্যে মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছে। তবে আমেরিকায় ইসলামফোবিয়ার এই বাড়বাড়ন্ত চেহারার পেক্ষাপট তৈরি হয়েছে নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার উপর দাঁড়িয়েই। একটি ধর্মকে ঢাল বানিয়ে আর অপব্যাখ্যা দিয়ে প্রাণের পর প্রাণ কেড়ে নিয়ে সন্ত্রাসীরা সাধারণ মুসলিমদের ‘মুসলিম’ পরিচয়কে অমুসলিমদের কাছে একটি ভয়ংকর ভয়ের বস্তু হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৩
আপনার মতামত জানানঃ