টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারণের দুর্নীতি মামলার রায় বুধবার ঘোষণা করেছেন আদালত। রায়ে প্রদীপ কুমার দাশকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তার স্ত্রী চুমকি ২১ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন।
জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য গোপন এবং অর্থপাচারের দায়ে কয়েকটি ধারা মিলিয়ে এ দণ্ডাদেশ দেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মুন্সী আব্দুল মজিদ। রায়ে তাদের অবৈধভাবে সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করারও আদেশ দেন আদালত। প্রদীপ কুমার দাশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যা মামলায় ফাঁসির আসামি।
দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাহমুদুল হক মাহমুদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আদালত চারটি ধারায় এই রায় ঘোষণা করেন। এরমধ্যে ২০০৪-এর ২৬ (২) ধারায় প্রদীপ কুমার দাশকে খালাস দেওয়া হয়, এই ধারায় চুমকিকে এক বছরের কারাদণ্ড, এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয় এবং অনাদায়ে একমাস কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২৭ (১) ধারায় প্রদীপ দুজনকেই আট বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪ (২)(৩) ধারায় উভয়কে ১০ বছর করে কারাদণ্ড ও চার কোটি টাকার অর্থ দণ্ড, অনাদায়ে দুই বছর করে কারাদণ্ড এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় এই দম্পতিকে দুই বছর করে করে কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অবৈধভাবে অর্জিত সব সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।’
প্রদীপ দম্পতির বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন অবৈধ সম্পত্তি। অবৈধভাবে অর্জিত উপার্জন হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে স্ত্রী চুমকি কারণের নামে জমি, ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ি স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি গড়েছেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ‘প্রদীপ কুমার দাশ প্রজাতন্ত্রের স্বল্প বেতনভোগী একজন কর্মচারী। চুমকি কারণ উক্ত কর্মচারীর স্ত্রী যিনি নিজে একজন গৃহবধূ। চুমকির নিজস্ব কোন আয় না থাকা সত্ত্বেও প্রদীপ কুমার দাশের অবৈধ উপার্জনকে বৈধ করার কৌশল হিসেবে চুমকি কারণকে মৎস্য ব্যবসায়ী ও কমিশন ব্যবসায়ী হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া দাখিল করা সম্পত্তির বিবরণীতে ২০ ভরি স্বর্ণের তথ্য গোপন করা হয়েছে। অপরাধ গোপনের লক্ষ্যে অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তির মূল্য কম দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অপরাধ করেছেন।’
টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন অবৈধ সম্পত্তি। অবৈধভাবে অর্জিত উপার্জন হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে স্ত্রী চুমকি কারণের নামে জমি, ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ি স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি গড়েছেন।
এর আগে গত ১৭ জুলাই প্রদীপ-চুমকি দম্পতির বিরুদ্ধে দায়ের করা দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিন ধার্য করেছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ মুন্সী আবদুল মজিদের আদালত।প্রদীপ দম্পতির পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করেন আদালত। ওইদিন আদালতে প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকিও উপস্থিত ছিলেন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ ডিসেম্বর প্রদীপ ও চুমকির বিরুদ্ধে দুদকের মামলায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। প্রদীপ কারাগারে থাকলেও তার স্ত্রী চুমকি তখন পলাতক ছিলেন। গত ২৩ মে চুমকি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
২০২০ সালের ২৩ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে চার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। দুদকের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানাধীন পাথরঘাটায় ৬ তলা বাড়ি, ষোলশহরে বাড়ি, ৪৫ ভরি সোনা, একটি গাড়ি, একটি মাইক্রোবাস, ব্যাংক হিসাব এবং কক্সবাজারের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে চুমকির নামে।
তাদের ৪ কোটি ৮০ লাখ ৬৪ হাজার ৬৫১ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিপরীতে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় দুই কোটি ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার ২৩৪ টাকা। দুই কোটি ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪১৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের সত্যতা পেয়েছে দুদক। এ ছাড়া চুমকি নিজেকে মৎস্য ব্যবসায়ী দাবি করলেও এ ব্যবসার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
এদিকে ২০২১ সালের ২৬ জুলাই প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুদক। মামলায় ২৯ সাক্ষীর মধ্যে ২৪ জন সাক্ষ্য দেন।
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধু আইন পরিপালন নিশ্চিত করা আর অপরাধ প্রতিরোধ বা দমনই নয়, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বলা হয়। এই বিভাগ যেকোনো দেশ ও জাতির একটি স্থায়ী সম্পদ। তারা আইন ও নীতি-নৈতিকতার ব্যাপারে উচ্চতর স্থানে থাকার কথা। অথচ সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে পুলিশের কিছু সদস্য বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ অন্যায় অনৈতিক কাজের কারণেই সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৭
আপনার মতামত জানানঃ