ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আঁচে বেশি পুড়ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। পেট্রল-ডিজেল বা রান্নার গ্যাস-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম একলাফে অনেকটাই বেড়ে গেছে। ইতোমধ্যে অস্থির শেয়ার মার্কেট এবং ক্রমবর্ধমান অপরিশোধিত তেলের দাম।
যুদ্ধের প্রভাব মারাত্মক হয়ে উঠেছে বাংলদেশের অর্থনীতিতেও।বিশেষ করে খাদ্য, জ্বালানি ও সারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরুর পর শুধু এ তিন পণ্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণেই নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে পতিত হতে যাচ্ছে দেশের অন্তত ৫০ লাখ মানুষ।
বাংলাদেশের দারিদ্র্যে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে আইএফপিআরআইয়ের এ পর্যবেক্ষণ সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ: ইম্প্যাক্ট অব দি ইউক্রেন অ্যান্ড গ্লোবাল ক্রাইসিস অন পভার্টি অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটি’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়েছে।
এতে দেখা যায়, যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি ও সারের দাম দ্রুত বেড়ে চলেছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, খাদ্যনিরাপত্তা ও দারিদ্র্যের হারে পণ্যগুলোর মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপক প্রভাব পড়ছে, যা এরই মধ্যে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
রুরাল ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পলিসি অ্যানালাইসিস (আরআইএপিএ) মডেলের ভিত্তিতে পরিচালিত আইএফপিআরআইয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে, যুদ্ধের সার্বিক প্রভাবে দেশের প্রকৃত জিডিপি কমেছে দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট। এর চেয়েও বেশি কমেছে কর্মসংস্থান, যার হার ১ দশমিক ৬ শতাংশ। খাদ্য, জ্বালানি ও সারের মূল্যে যুদ্ধের অভিঘাতে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসবে দেশের ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ। সেক্ষেত্রে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বাড়তে যাচ্ছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট। শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলেই এ অভিঘাত বেশি স্পষ্ট। যুদ্ধের প্রভাবে খাদ্য, জ্বালানি ও সারের মূল্য বাড়ায় গ্রামীণ দারিদ্র্য বাড়তে যাচ্ছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশীয় পয়েন্ট। শহরাঞ্চলে এ হার ২ শতাংশীয় পয়েন্ট।
যুদ্ধের সার্বিক প্রভাবে দেশের প্রকৃত জিডিপি কমেছে দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট। এর চেয়েও বেশি কমেছে কর্মসংস্থান, যার হার ১ দশমিক ৬ শতাংশ।
সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ভুট্টা, গম ও ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর চাহিদার বড় অংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করে বাংলাদেশ। এসব পণ্যের দাম ও আমদানি ব্যয় বেড়েছে। আবার স্থানীয় পর্যায়ে কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য ফসলি জমিতে ব্যবহার্য সারেরও সরবরাহ বিঘ্নিত হয়ে দাম বেড়েছে। এর ধারাবাহিকতায় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়ে বেড়েছে উৎপাদিত পণ্যের দামও।
এদিকে, শুধু খাদ্যপণ্য নয়, বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য্য অন্যান্য পণ্যের দামও। সাবান, টুথপেস্ট, ডিটারজেন্ট, নারিকেল তেল, সেভিং ফোম, টালকম পাউডার, রেজারসহ বিভিন্ন পণ্যের দামও বেড়েছে। ব্যয় সামলাতে না পেরে অনেকেই নিত্যব্যবহার্য্য পণ্যের তালিকাও কাটছাঁট করছেন বলে অনেকেই জানিয়েছেন।
এছাড়া আটা-ময়দার দাম বাড়ায় রুটি, কেক, বিস্কুটের মতো বেকারি পণ্যের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। আগে চায়ের দোকানে যে রুটি (বনরুটি) ও পিস কেক ৮ টাকা করে বিক্রি হতো, তা এখন ১০ টাকা। আবার ৩০ টাকা দামের ফ্যামেলি রুটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকায়।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নাজেহাল নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তরা। ভোগ্যপণ্যের বাজারে যেন অস্থিরতা কমছেই না। তেলের বাজারের আগুন শেষ হতে না হতেই বেড়েই চলেছে অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম। এতে করে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
গত জুন মাসে প্রকাশিত বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (বিআইজিডি) এক গবেষণায় বলা হয়, করোনা পরিস্থিতিতে দেশে তিন কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছিল। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই সংখ্যা কিছুটা কমলেও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে ২১ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে নানা কারণকে দোষারোপ করছেন সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৬২ শতাংশ মনে করছে, দুর্বল ব্যবস্থাপনার জন্যই এমনটি ঘটছে। এর পাশাপাশি সরবরাহের ঘাটতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধিকেও কারণ বলে মনে করে অনেকে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা হিসেবে সর্বোচ্চ ৬৯ শতাংশ মনে করে, ব্যবস্থাপনা বা সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বিস্তারের কথা বলেছে ৩৬ শতাংশ
যুদ্ধের প্রভাব নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষের ওপরেই বেশি পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা। তাদের ভাষ্যমতে, দেশে নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নির্ভর করবে যুদ্ধের স্থায়িত্ব এবং বর্তমান প্রবৃদ্ধির ধারা টিকে থাকার ওপর। দেশে বর্তমানে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক, ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। আগামী বছর সাড়ে ৭ শতাংশ হওয়ার প্রক্ষেপণ রয়েছে। যদি প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে নতুন করে দারিদ্র্যের কোনো কারণ নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যে মূল্যস্ফীতি, তার প্রভাব গ্রামীণ এলাকায় পড়বেই। এমনিতেও গ্রামীণ এলাকায় শহরের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি। বর্তমানে দেশে যে মূল্যস্ফীতি, সেটিও যুদ্ধের প্রভাবেই। সারা দেশেই এর প্রভাব দেখা যাবে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষ এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি।
এরমধ্যেই জাতিসংঘসহ অন্যান্য মানবিক ত্রাণ সহায়ক সংস্থাগুলো পৃথিবীব্যাপী অনাহার ও অপুষ্টিতে জীবনহানি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করছে। এনিয়ে আরও একবার সতর্ক করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেজ। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ সংকট “কোটি কোটি মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার প্রান্তে ঠেলে দিবে।” ফলে নজিরবিহীন অপুষ্টি ও ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে- যা কয়েক বছর ধরে চলতে পারে। আরও বেড়ে যাবে বৈশ্বিক মন্দার সম্ভাব্য ঝুঁকি।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রক্ষেপণ অনুসারে, প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ অনাহারে ভুগতে চলেছে। রাতের আহার থেকে বাদ পড়বে অন্তত ৮১ কোটি মানুষ। খরা ও সহিংসতা পীড়িত আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের ঘটনা ২০১৯ সালের মহামারি পূর্ব সময়ের চেয়ে ১০ গুণ বাড়বে।
ইউক্রেন ও রাশিয়া বিশ্বের গম রপ্তানির প্রায় ৩০ শতাংশ করতো। তাদের অন্যান্য প্রধান কৃষি রপ্তানির মধ্যে আছে ভুট্টা, যব ও সূর্যমুখীর তেল। রাশিয়ার আগ্রাসনের পর এসব পণ্যের সরবরাহ কমে গেছে বিশ্ববাজারে। কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় প্রধান এই শস্যগুলির দাম বিশ্ববাজারে আকাশ ছুঁয়েছে ইতোমধ্যেই।
এখন মনে হচ্ছে যুদ্ধ শিগগিরই শেষ হবে না। ইউক্রেন কৃষিজাত পণ্যের বড় সরবরাহকারী। কিন্তু এরই মধ্যে সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে। গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। তাদের নিয়ন্ত্রণের প্রভাবে জ্বালানির দামও বেড়ে যাচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও ভুগতে হচ্ছে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, বিদেশের বাজারে আজকে কোনো পণ্যের মূল্য বাড়লে তার প্রভাব দেশের বাজারে পড়তে অন্তত দুই থেকে আড়াই মাস লাগে। কিন্তু দেশি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা থেকে মনে হয়, আড়াই মাস পরে তো দূরের কথা, দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে সেটি কার্যকর করা হচ্ছে। শুধু কার্যকর নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের চেয়ে বেশি বাড়ানো হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনার আতঙ্কের মধ্যে সাধারণ মানুষের কাছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়া মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। করোনার কারণে আজ অনেকেরই চাকরি নেই, অনেকের ব্যবসা বন্ধ। কেউ বেকার ও নিঃস্ব হয়ে অসহায়ের মতো দিন কাটাচ্ছে। কেউ আবার তার ভালো চাকরিটি হারিয়ে রাস্তায় নেমে গেছে। দিনমজুর হয়ে কাজ করতেও অনেকে বাধ্য হচ্ছে শুধু পেটের তাগিদে; পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটুখানি খেয়ে-পরে বাঁচার আশায়। অবশ্য এ কষ্ট, এ যন্ত্রণা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। হয়তো যারা অকারণে খেয়াল-খুশিমতো এভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছেন, তারা বুঝতেও চান না সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা। সবার মধ্যেই যেন আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার স্বপ্ন বিরাজ করে সারাক্ষণ। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে এমন অবস্থা তো মেনে নেওয়া যায় না। দ্রব্যমূল্যের মনগড়া বৃদ্ধি অবশ্যই আমাদের ঠেকাতে হবে, কঠিন আইনের মাধ্যমে অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে এ নোংরা খেলা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪৬
আপনার মতামত জানানঃ