অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎশক্তি বৃদ্ধিই এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ খাতে মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণ গুনতে হয়েছে সরকারকে। গত ১৫ বছরে এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা।
পুরো অর্থই ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গেছে কতিপয় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পকেটে। গড়ে প্রতিবছর ৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে এই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে। অভিযোগ আছে, কেউ কেউ পুরোনো ও ভাঙাচোড়া বিদ্যুৎ প্লান্ট বসিয়েও ক্যাপাসিটি চার্জ হাতিয়ে নিয়েছে। একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্লান্ট-ফ্যাক্টর ৮০ শতাংশের ওপরে হলেও অনেক রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বছরে তার সক্ষমতার ১২ শতাংশ কোনোটি মাত্র ১৬ শতাংশ উৎপাদনে ছিল।
দেশে বিদ্যুতের চাহিদা না থাকা ও জ্বালানি সংকটে উৎপাদন সক্ষমতার একটি বড় অংশ অলস পড়ে থাকে। এ সময় না কিনলেও বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তাদের মোটা অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করে আসছে সরকারি সংস্থা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এভাবেই ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গত তিন বছর বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পকেটে গেছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো পিডিবির প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। বাড়তি সক্ষমতা সাড়ে ৭ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ সক্ষমতা অব্যবহূত থাকছে। উৎপাদন ক্ষমতা অনুসারে বিদ্যুৎ নিতে না পারায় দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রাকে প্রতি মাসে বড় অঙ্কের অর্থ দিতে হচ্ছে পিডিবিকে। চলতি বছরের মধ্যে আরও তিনটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদের রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মেয়াদ বারবার বাড়ানো হচ্ছে। ফলে সামনে ক্যাপাসিটি মাশুল আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। যদিও এখন সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যয় সাশ্রয়ে রেশনিং শুরু করেছে।
সূত্র জানায়, বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে সামিট গ্রুপকে। এ ছাড়া ইউনাইটেড গ্রুপ, বাংলা ট্র্যাক, চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি), ওরিয়ন গ্রুপ, ডরিন পাওয়ারসহ কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানির পকেটে ক্যাপাসিটি চার্জের বিপুল অর্থ গেছে।
পুরো অর্থই ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গেছে কতিপয় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পকেটে। গড়ে প্রতিবছর ৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে এই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ সরকারের ব্যয় হয় ১৮ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের ৮৩ কেন্দ্রের জন্য দিতে হয় ১৩ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের মধ্যে ৬১টি ছোট-বড় আইপিপি কেন্দ্রের মালিকরা পান প্রায় ৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ২২টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের পকেটে গেছে ১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। ভারত থেকে আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ না কিনেও প্রায় ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা দিতে হয়। পাবলিক খাতের ১৫টি সরকারি কোম্পানি ৪ হাজার ২২২ কোটি টাকা পায়।
২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ না কিনেও সরকারের ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা মাশুল দিতে হয়। বেসরকারি খাতের ৮১টি কেন্দ্রের পেছনে খরচ হয় ১৫ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬২টি আইপিপি ও সিআইপিপি কেন্দ্রের মালিক পান ১১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। ১৯টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মালিক বিদ্যুৎ না বেচেও পান ১ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ভারত থেকে আমদানিতে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ১ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। পাবলিক খাতের সরকারি কোম্পানির পেছনে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ৪ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা।
আর ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুন ‘২১ থেকে মার্চ ‘২২) বিদ্যুৎ না কিনেও সরকারের খরচ ১৬ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এই সময়ে ৭৩টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক পেয়েছেন ১২ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬১ আইপিপি উদ্যোক্তা নিয়েছেন ১১ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। ১২ রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের উদ্যোক্তারা বিদ্যুৎ না বেচেই পেয়েছেন ৬৭৮ কোটি টাকা। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দিতে হয়েছে ৮৬৯ কোটি টাকা। সরকারি কোম্পানিগুলো পেয়েছে ৩ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা শাখা পাওয়ার সেল বলছে, আপাতত নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের আর প্রয়োজন নেই। ২০৩১ সালে দেশে চাহিদা হবে ২৯ হাজার মেগাওয়াট। অনুমোদন পাওয়া ও নির্মাণ প্রক্রিয়ায় থাকা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পর উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৪১ হাজার মেগাওয়াট। এরপরও রহস্যজনক কারণে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হচ্ছে।
বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং সামাল দিতে ২০১০ সালে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপর অনুমোদন দেওয়া হয় একের পর এক ব্যয়বহুল রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের। যার অধিকাংশই ছিল ডিজেলচালিত।
যেখানে প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ পড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। চরম লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ মানুষজন এবং শিল্প-কলকারখানার মালিকরা তখন সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেও এখন এটি গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বারবার অপরিকল্পিত চুক্তি নবায়ন করার উদ্যোগ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার স্বল্প সময়ের কথা বললেও ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এসব রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনেকগুলোই বন্ধ করেনি। উলটো বারবার চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করে আসছে।
সম্প্রতি ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও চারটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবে ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ শর্তে মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা সবাই প্রভাবশালী ও সরকারি দলের নেতা। যার কারণে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নানা ছুতোয় ও অজুহাতে কেন্দ্রগুলো নবায়ন করা হচ্ছে।
তারা বলছেন, চাহিদার সঠিক হিসাব না করে সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়েছে। কোনো দর প্রক্রিয়া ছাড়া দায়মুক্তির বিধানের আওতায় এসব কেন্দ্র দেওয়া হয়েছে। চুক্তিতে এমন সব শর্ত রাখা হয়েছে, যাতে এক ওয়াট বিদ্যুৎ না বেচলেও বাড়তি মুনাফা করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না উদ্যোক্তাদের। শুধু তাই নয়, মেয়াদ শেষ হলেই বাড়ানো হয়েছে। এরই দায় এখন গোটা দেশ ভোগ করছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১৫৮
আপনার মতামত জানানঃ