পৃথিবীর ইতিহাসে এক ভয়ঙ্কর ও গভীর প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সাক্ষী ভূমধ্যসাগর। আজ এটি ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার মাঝখানে বিশাল এক জলরাশি হিসেবে অবস্থান করছে। কিন্তু এর ইতিহাস একদম ভিন্ন এবং চমকপ্রদ। প্রায় ছয় মিলিয়ন বছর আগে ভূমধ্যসাগর এক ভয়াবহ বন্যার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বন্যার মধ্যে একটি হিসেবে গণ্য হয়। এই ঘটনা পৃথিবীর ভূগোল ও পরিবেশে এক বিপ্লবী পরিবর্তন এনেছিল।
প্রায় ছয় মিলিয়ন বছর আগে যখন পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ অনেকটাই ভিন্ন ছিল, ভূমধ্যসাগরটি একটি বিচ্ছিন্ন সাগরীয় জলাধার ছিল। এর পূর্ব এবং পশ্চিম অংশ আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে সংযুক্ত ছিল একটি সংকীর্ণ প্রণালীর মাধ্যমে, যা ছিল জিব্রালটার প্রণালী। এই প্রণালী আটলান্টিক থেকে ভূমধ্যসাগরে পানির প্রবাহের প্রধান পথ হিসেবে কাজ করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের ক্রমাগত নড়াচড়ার ফলে আফ্রিকা প্লেট ইউরোপের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, যার ফলে জিব্রালটার প্রণালী সংকীর্ণ হতে থাকে।
এক পর্যায়ে এই সংকীর্ণ পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। আটলান্টিক মহাসাগরের জল প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভূমধ্যসাগরের পানি ক্রমশ শুকিয়ে যেতে থাকে। এতে ভূমধ্যসাগর এক বিশাল লবণাক্ত মরুভূমিতে পরিণত হয়, যেখানে পানির স্তর এতটা নেমে গিয়েছিল যে প্রায় ৯০ শতাংশ জল হারিয়ে যায়। ভূ-তাত্ত্বিক ও সামুদ্রিক গবেষণায় জানা গেছে, ভূমধ্যসাগরের তলদেশে এই সময় প্রচুর লবণ জমে, যার পুরুত্ব হাজার মিটার পর্যন্ত হতে পারে। এই লবণাক্ত স্তর আজও সাগরের তলদেশে থেকে গেছে।
এই সময়কালকে “মেসিনিয়ান সল্ট ক্রাইসিস” নামে পরিচিত, যা এক বিপুল জল সংকটের পরিচায়ক। ভূমধ্যসাগরের পানি কমে যাওয়ায় অঞ্চলের জলবায়ু ও বাস্তুতন্ত্রও ব্যাপক পরিবর্তিত হয়। যেসব প্রাণী ও গাছপালা এই অঞ্চলে বসবাস করত, তারা বাৎসরিক জলবাহিত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়।
আবার, প্রায় পাঁচ লাখ বছর পর, ভূ-তাত্ত্বিক পরিবর্তনের কারণে জিব্রালটার প্রণালী আবার খুলে যায়। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে বিশাল পানি প্রবাহ ভূমধ্যসাগরে ঢুকতে শুরু করে। এই প্রবাহ ছিল এতটাই প্রবল যে তা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যার একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ভয়ঙ্কর বন্যার জলের ঢেউ ভূমধ্যসাগরের শুকিয়ে যাওয়া অঞ্চলে ঢুকে তা পুনরায় জলমগ্ন করে তোলে।
বন্যার পানি দ্রুত ভূমধ্যসাগরের শুষ্ক অংশগুলোকে ভাসিয়ে দেয় এবং সাগরের ভৌগোলিক আকৃতি ও গভীরতা একেবারে নতুন রূপে গড়ে তোলে। বন্যার জল প্রবাহ ভূগর্ভস্থ জমে থাকা লবণ ধুয়ে দেয় এবং সমুদ্রের তলদেশ নতুন করে গঠন পায়। এই পুনর্জন্ম ভূমধ্যসাগরকে বর্তমানের মত একটি বিশাল জলরাশিতে পরিণত করে।
বন্যার এই ঘটনা শুধু ভূ-তাত্ত্বিক পরিবর্তনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর ফলে ভূমধ্যসাগরের আশেপাশের জলবায়ু ও পরিবেশ ব্যাপক পরিবর্তিত হয়। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু মানব সভ্যতার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মিশর, গ্রীক, রোমান ও ফিনিশিয়ানসহ বহু প্রাচীন সভ্যতা ভূমধ্যসাগরের আশেপাশে গড়ে উঠেছিল, যেখানে বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির বিস্তার ঘটেছিল।
আজকের যুগে আধুনিক ভূতাত্ত্বিক ও সামুদ্রিক গবেষণার মাধ্যমে এই ভয়ঙ্কর বন্যার ইতিহাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সিসমিক সার্ভে, লবণ ও পাথরের নমুনা বিশ্লেষণ, এবং জীবাশ্ম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন কীভাবে ভূমধ্যসাগর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর পুনরায় গড়ে উঠেছিল।
পৃথিবীর ইতিহাসে ভূমধ্যসাগরের সৃষ্টি এবং পুনর্জীবন কেবল ভূ-তাত্ত্বিক নয়, এটি মানুষের সভ্যতার ইতিহাসেও গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। এই সাগরের সৃষ্টি প্রমাণ করে প্রকৃতির শক্তি কতটা বিরাট এবং পৃথিবীর ভূগোল কতবার নতুন রূপে গড়ে উঠতে পারে। ভূমধ্যসাগর আজও মানব সভ্যতার ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
আপনার মতামত জানানঃ