সাড়ে ছয় কোটি বছর আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে বিশাল দেহের বিভিন্ন প্রজাতির এক একটি ডাইনোসর। ডাইনোসর নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই জনমনে। বিজ্ঞানীরাও এ নিয়ে দিনের পর দিন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সময় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে উদ্ধার হয়েছে ডাইনোসরের জীবাশ্ম। উন্মোক্ত হয়েছে অনেক রহস্য। তবে মানুষ যে তাদের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জেনে উঠতে পারেনি, তা প্রমাণিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক রেস্তোরাঁ প্রাঙ্গণে পাওয়া গেছে ডাইনোসরের পায়ের ছাপ। এই পায়ের ছাপ ১০ কোটি বছর আগের বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের সিচুয়ান প্রদেশের লেশান এলাকার এক রেস্তোরাঁর বাইরের প্রাঙ্গণে বড় আকৃতির কয়েকটি পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। পাথরের মধ্যে গভীর গর্ত করে থাকা এই পায়ের ছাপ দুটি ডাইনোসরের। আরও ভালো করে বললে দুটি সরোপডের। এ ধরনের ডাইনোসর আজ থেকে ১০ কোটি বছর আগে এই পৃথিবীতে বেঁচে ছিল বলে জানিয়েছেন চায়না বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্মবিদ লিডা জিং।
চায়না ইউনিভার্সিটি অব জিওসায়েন্সেসের সহযোগী প্রফেসর ও জীবাশ্মবিদ লিডা জিং বলেন, সিচুয়ান প্রদেশের লেশান রেস্তোরাঁর পাশেই পাথরের মধ্যে দুটি সরোপডের পায়ের ছাপ শনাক্ত করা হয়। পায়ের এই ছাপ অনেক গভীর এবং একেবারে স্পষ্ট। সরোপডোস এমন এক ধরনের ডাইনোসর, যারা প্রথম ক্রিটাসিয়াস সময়কালের। শনাক্তের পর লিডা জিংয়ের টিম শনিবার এই আবিষ্কারকে থ্রিডি স্ক্যানার ব্যবহার করে নিশ্চিত করেনে।
ডাইনোসরের মধ্যে সরোপডস প্রজাতির দীর্ঘ গলা এবং লেজ ছিল। এটিকে পৃথিবীতে এ যাবতকাল হেঁটে বেড়ানো সবচেয়ে বড় প্রাণি ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। এই ডাইনোসরগুলো বড় হলে তা তিনটি স্কুলবাসের সমান দীর্ঘ হতো। তারা এত ভারি ছিল যে, যখন মাটির ওপর দিয়ে হাঁটতো, তখন মাটি থর থর করে কাঁপতো।
যে দুটি ডাইনোসরের পায়ের ছাপ শনাক্ত করেছেন তাদের দেহের মাপ সম্ভবত ৮ মিটার বা ২৬ ফুটের মতো ছিল। এ পর্যন্ত জুরাসিক পিরিয়ডের যত সব ডাইনোসরের জীবাশ্ম সিচুয়ান থেকে আবিষ্কার করা হয়েছে, তার মধ্যে খুব কম জীবাশ্মই ক্রিটাসিয়াস পিরিয়ডের। যখন ডাইনোসরদের প্রকৃতপক্ষেই বিস্তার ঘটতে থাকে, সেই সময়টাকে ক্রিটাসিয়াস বলা হয়।
লিডা জিং বলেন, তারা যে দুটি ডাইনোসরের পায়ের ছাপ শনাক্ত করেছেন তাদের দেহের মাপ সম্ভবত ৮ মিটার বা ২৬ ফুটের মতো ছিল। এ পর্যন্ত জুরাসিক পিরিয়ডের যত সব ডাইনোসরের জীবাশ্ম সিচুয়ান থেকে আবিষ্কার করা হয়েছে, তার মধ্যে খুব কম জীবাশ্মই ক্রিটাসিয়াস পিরিয়ডের। যখন ডাইনোসরদের প্রকৃতপক্ষেই বিস্তার ঘটতে থাকে, সেই সময়টাকে ক্রিটাসিয়াস বলা হয়।
লিডা জিং বলেন, তার টিম খবর পাওয়া মাত্রই দ্রুত সে স্থানে যায়। কারণ, শহরে জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া কঠিন বিষয়। শহরগুলো পাকা দালানে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তার টিম এ জন্য ওই স্থান সফর করে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, তাদের মধ্যে আতঙ্ক নির্মাণ কাজের জন্য সেখানকার এসব সম্পদ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
ওই স্থানটিতে রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠার আগে, সেখানে ছিল মুরগির খামার। সেখানে ডাইনোসরের পায়ের ছাপ ময়লা আবর্জনা এবং বালুতে ঢাকা পড়ে ছিল। এর ফলে ওই পায়ের ছাপ ক্ষয় পাওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। আবহাওয়া বিষয়ক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। প্রায় এক বছর আগে যখন এই রেস্তোরাঁ খোলা হয়, শুধু তখনই সেখান থেকে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়। এর পাশে যে এলোমেলোভাবে পাথরের বিন্যাস রয়েছে, তার প্রাকৃতিক রূপ রেস্তোরাঁ মালিক খুব পছন্দ করেন। তিনি ওই এলাকায় আর কোনোকিছুই করেননি। সিমেন্ট দিয়ে লেভেলও করে দেননি। ফলে পায়ের ছাপ এর মধ্যে যেভাবে ছিল, সেভাবেই আবিষ্কার করা হয়েছে।
সিএনএন জানায়, এর আগে চীনের সিচুয়ান প্রদেশে জুরাসিক যুগের ডাইনোসরের জীবাশ্ম পাওয়া গেলেও এর ক্রিটাসিয়াস যুগের ডাইনোসরের অস্তিত্বের প্রমাণ এই প্রথম মিলল।
ক্রিটাসিয়াস যুগ সম্পর্কে লিডা জিং সিএনএনকে বলেন, এটি সাড়ে ১৪ কোটি থেকে সাড়ে ৬ কোটি বছর পর্যন্ত বিস্তৃত একটি সময়কাল। এই সময়েই ডাইনোসরদের সবচেয়ে বেশি বিস্তার হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। একই সঙ্গে এই পর্যায়ের পরই ডাইনোসর প্রজাতির ক্ষয় শুরু হয়। সিচুয়ানে সরোপডের পায়ের ছাপ পাওয়ায় এখন এটা নিশ্চিত যে, চীনে কয়েক ধরনের ডাইনোসর ছিল।
চীনে জীবাশ্মবিজ্ঞান ক্রমশ বিস্তার পাচ্ছে। আর এ কারণেই এখন এ সম্পর্কিত নতুন নতুন তথ্য সামনে আসছে।
তবে এ ক্ষেত্রে কিছু সংকটের কথাও জানান লিডা জিং। তার মতে, চীনে নগরায়ণ ব্যাপকভাবে হওয়ায় এ সম্পর্কিত গবেষণা কিছু বাধার সম্মুখীন হয়। শহরগুলো সব ভবনের দখলে। ফলে জীবাশ্মের দেখা মেলা কঠিন। এ জন্য কোনো সম্ভাবনাময় স্থানের খবর পেলেই সেখানে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ছুটতে হয়। কারণ, দেরি হলে দেখা যাবে, সেখানে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে গেছে হয়তো।
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ডাইনোসর নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। আগ্রহের শেষ নেই বিজ্ঞানী ও গবেষকদেরও।
বিশাল শরীর আর দাপুটে মেজাজ নিয়ে প্রায় ১৭ কোটি বছর পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে ডাইনোসর। পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের প্রাগৈতিহাসিক অধিবাসী এবং বৈজ্ঞানিকদের অনুমান প্রভাবশালী প্রাণী এরা। প্রথম ডাইনোসরের বিবর্তন হয়েছিল আনুমানিক ২৩ কোটি বছর পূর্বে। কোটি কোটি বছর আগে তা বিলুপ্তও হয়ে গিয়েছে।
ধারণা করা হয়, ৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে অন্তত ১০-১৫ কিলোমিটার প্রশস্ত গ্রহাণুর আঘাতের পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু গত বছর যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব রিডিং ও ব্রিস্টলের বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের ফসিলের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন, ওই উল্কাপাত বা গ্রহাণুর আঘাতের অন্তত ৫ কোটি বছর আগেই ডাইনোসরদের বিলুপ্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। গ্রহাণুর আঘাতে সেটি শেষ হয় মাত্র। পরিবর্তিত পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার কারণেই ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল বলে তারা মনে করেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ডাইনোসরের জন্মের সময় পৃথিবী ছিল উষ্ণ। কিন্তু দিনে দিনে পৃথিবী শীতল হয়ে আসতে শুরু করে। সমুদ্রের পানির উচ্চতাও নেমে যেতে শুরু করে। এর ফলেই ডাইনোসর বিলুপ্ত হতে শুরু করে। ডাইনোসরের সঙ্গে স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্ম অনেকটা একই সময়ে হলেও স্তন্যপায়ী প্রাণীরা শীতল পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১৪৭
আপনার মতামত জানানঃ