দেশের প্রথম মেট্রোরেলের আংশিক চালু হতে আর ৫ মাস বাকি। এমন সময়ে প্রকল্পের ব্যয় ৫০ শতাংশেরও বেশি বাড়তে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে সময়সীমাও বাড়ছে দেড় বছর।
মন্ত্রণালয়ে পাঠানো নতুন প্রস্তাবে ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। যা প্রায় একই সময়ে শুরু হওয়া ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা মেট্রোরেলের দ্বিগুণের বেশি। নকশা সমস্যা, প্রকল্পের বাইরে নানা প্রক্ষেপণ, জমি অধিগ্রহণে সমস্যাসহ পুরো প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ না হওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়।
যানজট থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে দ্রুত এগিয়ে চলছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। এই প্রকল্পের উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার অংশের কাজ বলতে গেলে শেষ। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে এই অংশে মেট্রোরেল চলাচল উদ্বোধন করা হবে। কাজ চলছে প্রকল্পের বাকি অংশেও।
কেন বাড়ছে ব্যয়
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলমান প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, অনুমোদিত ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। তবে মতিঝিল ছাড়িয়ে মেট্রোরেলের রুট কমলাপুর পর্যন্ত নেওয়ায় প্রকল্পের কাজ বেড়ে গেছে। সেজন্য পুরো প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে আরও প্রায় এক বছর বেশি সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে মেট্রোরেল প্রকল্পটি শেষ করতে সময় লাগবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। আর খরচ হবে আরও ১১ হাজার কোটি টাকা।
আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট লাইন-৬ বা এমআরটি লাইন-৬ নামে পরিচিত এই প্রকল্পের মেট্রো স্টেশনগুলোর নকশায় পরিবর্তন ও মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এলিভেটেড রেল লাইনের সম্প্রসারণের কারণে একটি বড় সংশোধনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের পাঠানো সংশোধন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রকল্প ব্যয় ৫২ দশমিক ২৫ শতাংশ বা ১১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা বেড়ে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকায় দাঁড়াবে। আগে এর ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা।
সরকারের ৮টি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের মধ্যে একটি এমআরটি লাইন-৬। এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময়সীমা ২০২৪ সালের জুনের থাকলেও সংশোধনের প্রস্তাবে তা বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর করার কথা বলা হয়েছে।
আজ সোমবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এই প্রস্তাব উত্থাপন করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক।
প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হলে এমআরটি লাইন-৬ হবে সপ্তম ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প, যেটি অন্তত একবার সংশোধন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত শুধু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি কোনো সংশোধন করা হয়নি।
অর্থায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা; নকশা, পরিকল্পনা ও জমি অধিগ্রহণ জটিলতা; বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা ও জবাবদিহিতার অভাব এবং করোনা মহামারির কারণে এই সময় ও ব্যয় বেড়েছে।
যদিও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, প্রথমে মেট্রোরেল রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণ করার পরিকল্পনা ছিল। তবে সেটি মতিঝিলের পরিবর্তে কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রথম পরিকল্পনা অনুসারে মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার। আর মতিঝিল-কমলাপুর অংশটির দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার। এতে মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য দাঁড়াচ্ছে ২১ কিলোমিটারের কিছু বেশি। উড়ালপথে (এলিভেটেড) নির্মাণাধীন এ মেট্রোরেলে আগে ১৬টি স্টেশন ছিল। কমলাপুর যুক্ত হওয়ায় এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৭টিতে। এসব বাড়তি কাজ বাস্তবায়নসহ নানান খাতের কারণে প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ছে, যার অংক ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা। মেয়াদও বাড়বে এক বছর। ফলে সংশোধন হচ্ছে মেট্রোরেল (এমআরটি লাইন-৬) প্রকল্প।
এখন সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে ডিএমটিসিএল। স্বল্প সময়ের মধ্যে সংশোধিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে পাঠানো হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডিপিপির দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাবে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকার ঋণ থেকে ১৯ হাজার ৬৭৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। সরকারি তহবিল থেকে ১৩ হাজার ৭৯৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। যদিও প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এখন নতুন করে যে ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা বাড়ছে, তার মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে আসবে আট হাজার ৪০৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা এবং জাইকার ঋণ থেকে ব্যয় হবে তিন হাজার ৮১ কোটি ১১ লাখ টাকা।
অবশ্য জাইকার ঋণ বাড়ানোর জন্য এখনো অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) প্রস্তাবনা যায়নি। এ বিষয়ে ইআরডির যুগ্ম-সচিব (জাপান শাখা) মুহম্মদ আশরাফ আলী ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় বাড়তে পারে শুনেছি। তবে প্রস্তাব এখনো আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। ডিএমটিসিএলসহ সংশ্লিষ্টরা সিদ্ধান্ত ফাইনাল করার পরেই আমাদের কাছে আসবে। এরপর বাড়তি টাকা প্রয়োজন হলে জাপানে প্রস্তাব পাঠানো হবে।
প্রকল্পের সময়-ব্যয় বাড়া প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বাড়তি অংশে ভূমি অধিগ্রহণ, নির্মাণ এবং ই অ্যান্ড এম সিস্টেম সংগ্রহ করা হবে। পাশাপাশি ট্রানজিট অরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্টের (টিওডি) জন্য ভূমি বরাদ্দ ও নকশা তৈরি, ট্রেন পরিচালনার বিদ্যুৎ খরচ এবং এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া স্টেশনে যাত্রী ওঠানামার জন্য লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি তৈরি, ফুটপাত নির্মাণ, পরামর্শক ব্যয় এবং আনুষঙ্গিক কার্যক্রমের জন্যও ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অন্যান্য মেট্রোরেলের ব্যয়ের সাথে তুলনা
জাপানের সহজ শর্তের ঋণে পরিচালিত প্রকল্পটি ২০১২ সালের ডিসেম্বরে অনুমোদিত হলেও ২০১৬ সাল পর্যন্ত এর কাজ শুরু করা হয়নি।
গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ছিল ৮১ দশমিক ১৯ শতাংশ। অথচ, মেট্রোরেলের উত্তরা-আগারগাঁও অংশ আগামী ১৬ ডিসেম্বর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা রয়েছে।
নির্মাণকাজ শেষ হলে মেট্রোরেল প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার মানুষকে পরিবহন করতে পারবে। বর্তমানে উত্তরা ও মতিঝিলের মধ্যে যাতায়াতে ২ ঘণ্টা সময় লাগলেও মেট্রো রেল চালু হলে তা কমে প্রায় ৪০ মিনিটে নেমে আসবে।
এর ফলে যাতায়াতের সময় ও যানবাহন পরিচালনার খরচের দিক থেকে বছরে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।
তবে ধীর গতির খেসারত হিসেবে ব্যয় আরও বাড়ার আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। বিশ্লেষকদের মতে, এ অভ্যাস থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে না পারলে মিলবে না সুফল। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক জানান, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ভাবে দায়সারা ভাবে পূর্ব অভিজ্ঞতা, সক্ষমতা ছাড়া এটি বাস্তবায়ন অপরিকল্পিত হবে।
অদূরদর্শী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ধীর গতির খেসারত আরো বহুগুণ বাড়ার শংঙ্কাও জানান বিশ্লেষকরা।
প্রথম থেকে মেট্রোরেলের ব্যয় নিয়ে ছিল বিতর্ক। ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিল থেকে যাওয়া এমআরটি লাইন-৬ ঢাকার বুক চিরে চলে গেছে। পাশাপাশি এর জন্য নগরবাসীর কোটি কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। ঢাকাবাসীকে অসহনীয় যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে।
এই মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য বিশ কিলোমিটার। পূর্বের ব্যয় অনুযায়ী প্রতি কিলোমিটারের ব্যয় ১০৯৪ কোটি টাকা। ভারতে এই ব্যয় ৪১৫ কোটি থেকে ৫০০ কোটি টাকা। ভিয়েতনামের ১৩ কিলোমিটার লম্বা হ্যানয় লাইনের খরচ পড়েছে ৬০৮ কোটি টাকা। সিঙ্গাপুরে পড়েছে ৫৮৯ কোটি টাকা। হো চি মিন সিটি লা ইন-১ এর খরচ পড়েছে ৮৭৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাম্প্রতিক কালে তৈরি হওয়া সবচেয়ে ব্যয়বহুল মেট্রো রেল লাইন হলো ঢাকা এমআরটি লাইন-৬। এবার ব্যয় বৃদ্ধি, এই পার্থক্যকে আরও বড় করেছে।
এমআরটি লাইন-৬ নির্মানের পর আরো দুইটি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে। এই প্রস্তাবিত দুইটি লাইনের নির্মাণ ব্যয় বর্তমান লাইনের চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ। ১৮৩০ কোটি টাকা প্রতি কিলোমিটারের ব্যয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৪৮
আপনার মতামত জানানঃ