যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় বেশ কিছু আরব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকের পথে হাঁটছে ইসরায়েল। ইতোমধ্যেই অনেক দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের চুক্তিও হয়েছে। এবার তারই ধারাবাহিকতায় ইসরায়েলকে নিজেদের আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে সৌদি আরব। ফলে এখন থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতগামী ইসরায়েলের বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের বিমান সৌদির আকাশপথ ব্যবহার করতে পারবে।
দৃশ্যত ইসরায়েলের প্রতি উদার মনোভাবের অংশ হিসেবে আজ শুক্রবার এ ঘোষণা দেওয়া হলো। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সৌদি আরব সফরের আগমুহূর্তে এ ঘোষণা এল। খবর এএফপির।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো চার দিনের মধ্যপ্রাচ্য সফর করছেন জো বাইডেন। বুধবার ইসরায়েলে পৌঁছানোর পর গতকাল বৃহস্পতিবার বাইডেন পশ্চিম জেরুজালেমে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতি দেন দুই দেশের নেতারা। বিবৃতিতে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে নিজেদের অভিন্ন অবস্থানের কথা জানান তারা।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তেহরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন ঠেকাতে একসঙ্গে কাজ করবে দুই দেশ।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন ঠেকাতে জাতীয় শক্তির সম্ভাব্য সব বিষয় ব্যবহার করবে ওয়াশিংটন। একই সঙ্গে চুক্তির শর্ত মেনে ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দেন বাইডেন।
জেরুজালেমে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ইয়ার লাপিদ বলেন, ইরানের হুমকির বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ইরানের ওপর বিশ্বশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই দেশটিকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন প্রতিহত করা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে বাইডেন বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথ থেকে ইরানকে ফেরাতে সবচেয়ে ভালো কৌশল হতে পারে কূটনীতি।
আমেরিকা ও ইসরাইলের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলো বহু বছর ধরে অভিযোগ করে আসছে যে, ইরান গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করার লক্ষ্যেই পরমাণু কর্মসূচি পরিচালনা করছে। ইরান কঠোর ভাষায় এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, দেশটির পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এবং বেসামরিক কাজে ব্যবহার করার লক্ষ্যে এ কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে।
ইরান আরও বলেছে, পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী এবং আইএইএর সদস্য দেশ হিসেবে বেসামরিক কাজে পরমাণু শক্তি ব্যবহার করার পূর্ণ অধিকার তেহরানের রয়েছে।
ইসরায়েলের সঙ্গে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই সৌদি আরবের। এত দিন দেশটির আকাশসীমা ব্যবহার করে ইসরায়েলে চলাচলের ক্ষেত্রে উড়োজাহাজগুলোর ওপর বিধিনিষেধ ছিল। এখন সেই বাধা আর রইল না।
ইসরায়েলের সঙ্গে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই সৌদি আরবের। এত দিন দেশটির আকাশসীমা ব্যবহার করে ইসরায়েলে চলাচলের ক্ষেত্রে উড়োজাহাজগুলোর ওপর বিধিনিষেধ ছিল। এখন সেই বাধা আর রইল না।
উড়োজাহাজ চলাচলে সৌদির এ সিদ্ধান্তকে ‘ঐতিহাসিক’ মন্তব্য করে স্বাগত জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ইসরায়েলের প্রতি ইতিবাচক মনোভাবের এটি রিয়াদের সর্বশেষ সমঝোতামূলক পদক্ষেপ। আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে ইসরায়েলের ব্যাপক তৎপরতা সত্ত্বেও দেশটিকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে সৌদি।
টুইটারে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, উড্ডয়নে কর্তৃপক্ষের আবশ্যিক শর্তাবলি পূরণ করে—এমন সব উড়োজাহাজের জন্য সৌদি আরবের আকাশসীমা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছে সৌদি বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষ।
তিনটি মহাদেশকে যুক্তকারী একটি বৈশ্বিক কেন্দ্র হিসেবে সৌদি আরবের অবস্থান সুসংহত করার সরকারি প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেনে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্ত সৌদি আরবের সঙ্গে অনেক মাস ধরে প্রেসিডেন্টের অবিচল ও নীতিগত কূটনীতির ফল, যা আজ তার সফরে চূড়ান্ত পরিণতি পেল।
মধ্যপ্রাচ্য সফরের অংশ হিসেবে আজ দিনের শেষ দিকে বিতর্কিত এক ভ্রমণে সৌদি আরব যাচ্ছেন বাইডেন। জ্যাক সুলিভান বলেন, আজ দিন শেষে এ অর্জনের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট আরও বিস্তারিত বলবেন।
মধ্যপ্রাচ্য সফরের অংশ হিসেবে গত বুধবার ইসরায়েল পৌঁছান বাইডেন। আরও আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে পদক্ষেপ নিতে পারে বলে এর আগে ইঙ্গিত দিয়েছিল ওয়াশিংটন। এতে ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংঘাতের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত দাপ্তরিকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপন না করার বিষয়ে রিয়াদের দীর্ঘদিনের অবস্থানের পরিবর্তন নিয়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আব্রাহাম অ্যাকর্ডের অধীন ২০২০ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। একই পথ অনুসরণ করে বাহরাইন ও মরক্কো। আঞ্চলিক মিত্রদের এমন পদক্ষেপের বিরোধিতা করেনি সৌদি আরব।
এদিকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আরব দেশগুলো প্রধান তিনটি শর্ত দিয়েছিল। সেগুলো হলো, যুদ্ধের সময় আরব দেশগুলোর দখল করা জমি ছেড়ে দেওয়া, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ও স্বীকৃতি এবং ফিলিস্তিনের দখল করা জমি হস্তান্তর। সেই শর্তের কোনোটা পূরণ না হওয়ার পরও আরব দেশগুলো ইসরায়েল রাষ্ট্রটির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে।
ইসরায়েলের সঙ্গে একের পর আরব দেশের সম্পর্ক জোড়া লাগুক না কেন, বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বহু দূরেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। বৃহত্তর এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা ইসরায়েল–ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের বিষয়টি। স্বাভাবিকভাবে, ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, এখন তা নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে।
আরব বিশ্ব ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বিনিময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনে ছিল অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু আরব বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করেছে ইসরায়েল। আর ফিলিস্তিনিরা এখনো পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে অধিকৃত অবস্থায় আছে, যা গাজার মতোই একটি উন্মুক্ত কারাগারের শামিল।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, লাভের মধু ইসরায়েলেরই বেশি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বা সামরিক—যেটাই হোক না কেন। আরবদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে আনাটা ইসরায়েলের জন্য বড় সাফল্যই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৩
আপনার মতামত জানানঃ