পশ্চিমবঙ্গে করোনা সংক্রমণের মধ্যে নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে ‘নাইরোবি ফ্লাই’। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় উত্তরবঙ্গে এ মাছির আক্রমণে সংক্রমিত হয়েছেন ১৬ জন। গত সাত দিনে সংক্রমণের সংখ্যা একশ ছাড়িয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি সিকিমেও এ মাছি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। সম্প্রতি সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে পূর্ব সিকিমের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। কারণ এই কলেজরই প্রায় ১০০ জন ছাত্র আক্রান্ত হয়েছেন ত্বকের এক বিশেষ সংক্রমণে। স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকদের মতে, এই ছাত্রদের প্রত্যেকেই নাইরোবি মাছির সংস্পর্শে এসেছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাইরোবি ফ্লাই প্রথম দেখা যায় পূর্ব আফ্রিকায়। এটিকে ‘কেনিয়া মাছি’ বা ‘ড্রাগন মাছি’ও বলা হয়। প্রধানত উচ্চ বৃষ্টির পাহাড়ি বা জঙ্গল অধ্যুষিত এলাকায় এ মাছি দেখা যায়।
এদের রঙ লাল আর কালো। মাথার দিকটা কালো হয় আর পেট হয় লাল। ছোট্ট এই পোকার দৈর্ঘ্য ৬ থেকে ১০ মিলিমিটার। অ্যাসিড পোকা কামড়ালে ক্ষতস্থানে জ্বালাপোড়া, ব্যথা, বমিভাব, মাথাব্যথা, জ্বর হতে পারে। পোকাটি এতটাই ক্ষতিকর যে, পোকাটির সংস্পর্শে যদি কারও চোখে ক্ষত হয় সেই ব্যক্তি দৃষ্টিশক্তিও হারাতে পারেন।
এরা সচরাচর কামড়ায় না। মানুষের শরীরে বসলেই সংক্রমণ হতে পারে। এর দেহে পেডেরিন নামক এক ধরনের তরল আছে, যা সংস্পর্শে এলে সংক্রমণ ঘটে। আফ্রিকার বাইরে ভারত, জাপান ও ইসরায়েলে এ মাছি দেখা যায়।
উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিন ডা. সন্দীপ সেনগুপ্ত বলেন, এ মাছির কামড়ে চামড়ায় সংক্রমণ হয়। অ্যাসিডে পোড়ার মতো চামড়ার অনেকটা জায়গায় ফোসকা পড়ে যায়। বিষের ডোজ বেশি হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিডনিও বিকল হতে পারে। চোখে এ মাছির বিষ লাগলে অন্ধ হওয়ার শঙ্কা থাকে।
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এ মাছির দেহ থেকে নির্গত তরল ত্বকে পড়লে জ্বালাপোড়া বা ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। এক দু’দিনের মধ্যেই দেহে ফোসকা পড়ে। তবে এগুলো সাধারণত শুকিয়ে যায়; দাগ হয়ে থেকে যায় না। গুরুতর ক্ষেত্রে বিষ শরীরে ছড়িয়ে পড়লে জ্বর, স্নায়ুর ব্যথা, গাঁটে ব্যথা বা বমি হতে পারে।
সতর্কতা হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এ মাছি গায়ে বসলে তাকে তাড়িয়ে দিতে হবে। গায়ের সঙ্গে পিষে ফেলা যাবে না। মাছিটি আলোর প্রতি আকর্ষিত হয়, তাই সূর্যাস্তের পর দরজা-জানালা বন্ধ করে দিতে হবে।
নাইরোবি ফ্লাই নিয়ে ভয়ের কিছুই নেই বলে দাবি করছেন পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যবিভাগ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। শুধু মানুষকে একটু সচেতন থাকতে হবে। তাহলেই এই পোকার বাড়বাড়ন্ত প্রতিরোধ করা যাবে।
বাড়ির চারিদিক ও জলাধার পরিষ্কার–পরিচ্ছন রাখা, সন্ধ্যের আগে বাড়ির দরজা, জানালা বন্ধ রাখা, ঘরে সাদা আলোর পরিবর্তে হলুদ আলো ব্যবহার করতে হবে। ঘুমোনোর সময় মশারি টাঙানো এবং আলো নিভিয়ে দেওয়া, বিছানার চাদর, বালিশ, তোষক পরিষ্কার রাখতে বলা হচ্ছে।
নাইরোবি মাছির সংক্রমণ থেকে বাঁচার উপায়
এই মাছিঘটিত সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে কী কী করতে হবে, বিজ্ঞানীরা কয়েকটি পরামর্শ দিচ্ছেন।
- বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধান কাজ হল, রাতে শোওয়ার সময় অবশ্যই মশারি টাঙানো।
- এই মাছি যদি শরীরে এসে বসে, তবে কখনও হাত দিয়ে মাছিটিকে সরানো উচিত নয়। অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে, হাত না লাগিয়ে মাছিটিকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার।
- মাছিটি যেখানে বসেছিল সেই জায়গাটি খুব ভালো করে সাবান জল দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। যদি ওই মাছির থেকে বেরনো কোনও তরল পদার্থ শরীরের কোনও অংশে লেগে থাকে, খেয়াল রাখতে হবে যাতে ওই অংশ শরীরের অন্য কোথাও স্পর্শ না করে।
- বিশেষ করে খেয়াল রাখতে হবে ওই মাছি যেন কোনও ভাবেই চোখের উপর না বসতে পারে।
সিকিম ছাড়া ভুটানের কিছু অংশে এই রোগ ছড়িয়েছে। উত্তর বঙ্গের শিলিগুড়ির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে বলে স্থানীয় চিকিৎসকরা বলছেন। শিলিগুড়ির এক চিকিৎসক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে দৈনিক ১৫ থেকে ২০ জন রোগী আসছেন, যাঁরা নাইরোবি মাছির দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন।
এই মাছির আক্রমণের ভয়াবহতা দেখা গিয়েছিল ১৯৯৮ সালের কেনিয়াতে। এছাড়া, আফ্রিকার বাইরে ভারত, জাপান, ইজরায়েলে এই মাছির আক্রমণ দেখা গিয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩৫
আপনার মতামত জানানঃ