রাগ-ক্ষোভ-ক্রোধ, মানসিক চাপ ও বিষণ্নতা-বিমর্ষতার দিক বিবেচনায় বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। এ তালিকার প্রথম স্থানে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান।
বিশ্বে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সূচকে থাকা দেশগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের জনমত জরিপকারী সংস্থা গ্যালপ। সেখানে সর্বোচ্চ নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সূচকে প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে সপ্তম স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ।
২০২১ ও ২০২২ সালের শুরুর দিকে বিশ্বের ১২২টি দেশের ১ লাখ ২৭ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে গ্যালপ এ তালিকা প্রকাশ করেছে যার নাম ‘গ্লোবাল ইমোশনস রিপোর্ট-২০২২ ’।
বাংলাদেশে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত জরিপটি পরিচালনা করেছে গ্যালপ। এতে মোট ১ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অংশ নিয়েছেন।
গ্লোবাল ইমোশনস রিপোর্টে চারটি বিভাগ রয়েছে—সর্বনিম্ন ইতিবাচক অভিজ্ঞতা সূচক, সর্বোচ্চ ইতিবাচক অভিজ্ঞতা সূচক, সর্বনিম্ন নেতিবাচক অভিজ্ঞতা সূচক ও সর্বোচ্চ নেতিবাচক অভিজ্ঞতা সূচক। এসব সূচক নির্ধারণ করা হয়েছে মানুষের রাগ-ক্ষোভ-ক্রোধ, মানসিক চাপ ও বিষাদের অভিজ্ঞতার আলোকে।
গ্যালপের প্রতিবেদন বলছে, রাগ-ক্ষোভ-ক্রোধ, মানসিক চাপ ও বিষাদের দিক থেকে একেবারে শীর্ষে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তান। দেশটির স্কোর ৫৯। সেখানে সপ্তম স্থানে থাকা বাংলাদেশের স্কোর ৪৫। একই স্কোর নিয়ে ৭ম অবস্থানে আছে ইকুয়েডর ও গিনি। এ ছাড়া ৫৮ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে লেবানন এবং ৫১ স্কোর নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইরাক।
অন্যদিকে সর্বোচ্চ ইতিবাচক অভিজ্ঞতা তথা সবচেয়ে কম নেতিবাচক অভিজ্ঞতার দেশের তালিকায় শীর্ষে আছে পানামা। দেশটির স্কোর ৮৫। এ ছাড়া ৮৪ স্কোর নিয়ে যৌথভাবে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইন্দোনেশিয়া ও প্যারাগুয়ে। আর ৮২ স্কোর নিয়ে তৃতীয় আবস্থানে রয়েছে তিনটি দেশ—এল সালভাদর, হন্ডুরাস ও নিকারাগুয়া।
গ্যালপের সিইও জন ক্লিফটন স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমীক্ষার প্রয়োজনে যেসব ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে তাদেরকে শারীরিক ব্যথা, উদ্বেগ, দুঃখ, চাপ এবং রাগ অনুভব করেছেন কিনা এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল। এসব প্রশ্নের উত্তরের ভিত্তিতেই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা সূচক তৈরি করা হয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তরে ৪২ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা অনেক বেশি উদ্বেগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, যা ২০২০ সালের তুলায় দুই শতাংশ বেড়েছে।
রাগ-ক্ষোভ-ক্রোধ, মানসিক চাপ ও বিষাদের দিক থেকে একেবারে শীর্ষে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তান। দেশটির স্কোর ৫৯। সেখানে সপ্তম স্থানে থাকা বাংলাদেশের স্কোর ৪৫।
এ ছাড়া প্রতি দশজন উত্তরদাতার মধ্যে তিনজন বলেছেন, তারা শারীরিক ব্যথা পেয়েছেন, যা মোট উত্তরদাতার ৩১ শতাংশ। প্রতি চারজনের একজন বলেছেন, তারা অনেক বেশি দুঃখ পেয়েছেন, যা মোট উত্তরদাতার ২৮ শতাংশ।
জন ক্লিফটন বলেছেন, ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সাল অনেক বেশি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও বিষণ্নতার ভেতর দিয়ে কাটিয়েছে বিশ্বের মানুষ।
সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসায় প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস নিয়ে জনমনে উদ্বেগ কিছুটা কমেছে। তবে গত দুই বছরে মানুষের মনের গভীরে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে সময় লাগবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ কারোনাকালে অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে। চাকরি হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তায় পড়েছেন অনেকে। প্রিয়জনের সংক্রমণ ও মৃত্যু, বেকারত্ব এবং জীবনযাপনের স্বাভাবিক পরিস্থিতি না থাকায় মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে এই সময়ে।
করোনাকালের শুরু থেকেই অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়া বা অনিশ্চিত জীবন নিয়ে ভীত হয়ে উদ্বেগ ও বিষণ্নতায় ভোগা মানুষদের কথা বহুবার আলোচনা হয়েছে। নানান শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে এ বিষয়ে গবেষণাও হয়েছে বিস্তর। তবে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন নতুন গবেষণা বলছে, মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বাসা বাঁধছে নতুনভাবে। ঘুণ পোকার মতো তা ক্ষয় ধরাচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যে। এই বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থার বড় আঘাত পড়েছে বাংলাদেশেও। এক গবেষণা বলছে, করোনাকালে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্নতায় বাংলাদেশ শীর্ষে।
করোনাকালের ধকল কাটিয়ে সংকটে থাকা ব্যক্তিরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে তো- এ প্রশ্ন অনেকের। সঠিক পরিচর্যা পেলে মানসিক সংকটে থাকা ব্যক্তিরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, মানসিক সংকটে থাকা ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
তারা বলেন, করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় মানসিক চাপ বেড়ে যায়। পরিবারের সদস্যদের সংক্রমিত হওয়ার ভয়, নিজে সংক্রমিত হলে চিকিৎসার সুযোগ মিলবে কিনা, তা নিয়ে মানসিক চাপ তৈরি হয়। একই সঙ্গে সংক্রমিত হয়ে আইসোলেশনে থাকাকালীন একাকিত্ব নিয়েও ছিল আতঙ্ক। এ ছাড়া কাছের মানুষের মৃত্যু মনকে শোকাতুর করে তোলে। ভীতিকর চিত্র বা সংবাদ দেখে আতঙ্কবোধ করা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন; এমন ব্যক্তি যখন দেখেন অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না, তখন তিনি মানসিক চাপ অনুভব করেন।
তারা আরও বলেন, চিকিৎসাসেবার কর্মীরা বাড়তি কাজের চাপের কারণে মানসিক সমস্যায় পড়েন। এ ছাড়া করোনাকালে অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। এতে মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৮
আপনার মতামত জানানঃ