নোয়াম চমস্কিকে বর্তমান বিশ্বের প্রবীণতম ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী হিসেবে মনে করা হয়। ৯১ বছর বয়সী চমস্কি মূলত ভাষাবিজ্ঞানী হলেও এখন তার পরিচয় ‘প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে। বামঘেঁষা এই শিক্ষাবিদ সমসাময়িক নানা বিষয়ে নিয়মিত কলাম লিখছেন এবং সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন বিভিন্ন বিখ্যাত পত্রিকা ও সাময়িকীতে। তিনি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর এমেরিটাস এবং আরিজোনা ইউনিভার্সিটির লরিয়েট প্রফেসর। লিখেছেন ১২০টি বই এবং হাজার হাজার নিবন্ধ।
এ দিকে ভয়াবহ ভাইরাস করোনার ব্যাপক সংক্রমণ ও তাণ্ডবে বিশ্ব স্থবির হয়ে পড়েছে। লাখ লাখ মানুষ করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। বাস্তবে তাদের সংখ্যা এর কয়েকগুণ বেশি হতে পারে। করোনায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে অত্যন্ত উদ্বেগজনকহারে। ফলে বিশেষত পুঁজিবাদী অর্থনীতি ধসে পড়ার উপক্রম। বিশ্বজনীন মহামন্দা এখন অনিবার্য। বহু আগেই করোনা ক্রাইসিসের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। তবে প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দরুন এর মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে বিলম্ব ঘটেছে। এ অর্থনীতির নিষ্ঠুর মনোবৃত্তির সারকথা : ‘ভবিষ্যৎ মহামারীর প্রতিরোধের মাঝে বর্তমানের কোনো মুনাফা নেই।’ এখানে ‘ট্রুথআউট’ মিডিয়াকে এক সাক্ষাৎকারে নোয়াম চমস্কি বলেছেন, কিভাবে ‘নব্য উদারতাবাদী’ ধনতন্ত্র করোনা মহামারীকে বর্তমান পর্যায়ে উপনীত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় আক্রান্তের ও মৃতের সংখ্যা সর্বাধিক। সে দেশে প্রাণহানি এত বেশি যে গণকবর খুঁড়তে হয়েছে এবং মর্গে কোনো ঠাঁই নেই। অথচ ট্রাম্পের এই আমলে সেখানে হাসপাতালের চেয়ে কারাগার নির্মাণ পেয়েছে অধিক গুরুত্ব। এ ছাড়া শ্রমিকদের মাঝে করোনা সংক্রমণ হয়েছে কি না, তার হিসাব রাখা নিষ্প্র্রয়োজন বলে মার্কিন প্রশাসন মনে করে। আলোচ্য সাক্ষাৎকার ভাষান্তর করেছেন মীযানুল করীম।
প্রশ্ন : নোয়াম, নতুন করোনভাইরাসজনিত ব্যাধি বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। অথচ চীনেই ভাইরাসটির উদ্ভব। এগুলো কি বিস্ময়কর ঘটনা?
নোয়াম চমস্কি : এ মহামারীর মাত্রা বিস্ময়কর। আসলে এটা চরমভাবে আঘাত হেনেছে। তবে এর আবির্ভাবে অবাক হওয়ার কারণ নেই। আর যুক্তরাষ্ট্র যে এসব সঙ্কটেও সাড়া দেয়ার বেলায় সবচেয়ে খারাপ রেকর্ড গড়েছে, এ সত্য বিস্ময়কর নয়।
বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর এহেন মহামারীর ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছেন। বিশেষত ২০০৩ সালে সার্স মহামারী দেখা দেয়ার পর থেকে তারা এ বিষয়ে জোর দিচ্ছেন। সার্সেরও কারণ করোনাভাইরাস। নতুন মহামারীটির মোকাবেলার জন্য একাধিক টিকা উদ্ভাবন করা হলেও তা ক্লিনিক্যাল লেভেলে পৌঁছতে পারেনি। এমন বিপর্যয়ে দ্রুত সাড়া দেয়ার ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত সক্ষমতা সৃষ্টির কাজ তখনই শুরু করে দেয়া উচিত ছিল। এ ধরনের রোগজীবাণুর পুনরায় প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা রোধের জন্য আত্মরক্ষা ও চিকিৎসার উপায়-উপকরণ উদ্ভাবনের উদ্যোগ নেয়া যেত। তবে বৈজ্ঞানিক উপলব্ধিই পর্যাপ্ত নয়। এ ক্ষেত্রে ‘বল তুলে নিয়ে এর সাথে দৌড়ানো’র জন্য কেউ না কেউ থাকা চাই।
সমকালীন আর্থসামাজিক ব্যবস্থার দুর্বলতা সে পথকে রুদ্ধ করে দেয়। বাজারের সঙ্কেত ছিল স্পষ্ট : ‘ভবিষ্যৎ দুর্যোগ প্রতিরোধে কোনো লাভ নেই।’ সরকার কোনো পদক্ষেপ নিতে পারত। কিন্তু এ ব্যাপারে সে ডকট্রিন বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যা বর্তমানে কর্তৃত্ব করছে। তা হলো- ‘সরকারই সমস্যা।’ (সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট) রিগ্যান হেসে এ কথা আমাদের বলেছিলেন। তিনি এর দ্বারা বুঝিয়েছেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজটা পুরোপুরিই ব্যবসার জগতের হাতে তুলে দিতে হবে। এ জগৎ বেসরকারি মুনাফা অর্জনে লিপ্ত এবং তাদের প্রভাব থেকে মুক্ত, যারা জনসাধারণের কল্যাণের জন্য উদ্বিগ্ন। পরবর্তী বছরগুলোতে বেলাগাম ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নব্য উদারতাবাদের নির্মমতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সেই সাথে এর ফলে বাজারের ধরন হয়ে গেছে বিকৃত।
ব্যাধির গভীরতা সুস্পষ্টভাবে উন্মোচিত হয়েছে সর্বাপেক্ষা নাটকীয় ও ঘাতক ব্যর্থতাগুলোর একটির মধ্য দিয়ে। তা হচ্ছে ভেন্টিলেটরের অভাব। করোনা মহামারী মোকাবেলায় এটা একটা বড় বাধা। আমেরিকার স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগ আগেই তা উপলব্ধি করেছে। সে মোতাবেক, তারা একটি ছোট প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করেছিল যাতে ব্যয়বহুল নয় এবং সহজে ব্যবহার করা যায়- এমন ভেন্টিলেটর তৈরি করা যায়। কিন্তু তখন ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী যুক্তির হস্তক্ষেপ ঘটল। ওই প্রতিষ্ঠানটিকে ‘কোভিডিয়েন’ নামের বৃহৎ করপোরেশন কিনে নেয়। তবে প্রকল্পটিকে এড়িয়ে যাওয়া হলো। মার্কিন সরকারকে যখন কোনো ভেন্টিলেটর দেয়া হয়নি, তখন ২০১৪ সালে কোভিডিয়েন কর্মকর্তারা (ফেডারেল) বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ এজেন্সিকে জানায়, তারা সংশ্লিষ্ট চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছুক। এটা জানিয়েছেন সাবেক ফেডারেল কর্মকর্তারা। তখন বলা হয়েছিল, সে করপোরেশন বা কোম্পানির জন্য ভেন্টিলেটর উৎপাদন করা যথেষ্ট লাভজনক নয়।
এটা নিঃসন্দেহে সত্য যে, এ অবস্থায় নব্য উদারতাবাদের যুক্তির হস্তক্ষেপ দেখা গেছে। এর মাধ্যমে সরকারকে বলা হয় যে, সরকার বাজারে বিরাট ব্যর্থতা এড়াতে পারেনি। এতে চলমান বিপর্যয়ের জন্ম হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস নমনীয়ভাবে উল্লেখ করেছে, ‘সস্তা ও সহজে ব্যবহারযোগ্য ভেন্টিলেটর উৎপাদনের স্থগিত প্রয়াসের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য বিষয়ে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে দিয়ে আউট সোর্সিংয়ের বিপদ প্রকট হয়ে উঠেছে। তারা মুনাফাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিতে চান। এটা ভবিষ্যৎ সঙ্কট মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়ার যে সরকারি লক্ষ্য, এর সাথে সর্বদা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’ দিলদরিয়া সরকারকে কুর্নিশ করার প্রথা এবং এর লক্ষ্যের প্রশংসা করার বিষয় বাদ দিলেও পত্রিকাটির বক্তব্যের সত্যতা পর্যাপ্ত।
এর সাথে আমরা যোগ করতে পারি, ‘মুনাফাকে চরমে তোলা মানবতার অস্তিত্বের আশাবাদের সাথেও সবসময় সামঞ্জস্যশীল নয়।’ যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম ব্যাংক জেপি মর্গান চেজ হুঁশিয়ারি দিয়েছে, আমাদের বর্তমানে অনুসৃত পন্থায় মানবতার অস্তিত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য ব্যাংকটির নিজস্ব বিনিয়োগের কথাও প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়। একইভাবে, শেভরন কোম্পানি একটি টেকসই জ্বালানি প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে। কারণ পৃথিবীতে জীবন ধ্বংসের মুনাফা সে তুলনায় বেশি। এক্সসন মবিল তা কমেনি। কারণ তারা এমন কোনো প্রকল্পে হাত দেয়নি। লাভ করার ব্যাপারে তাদের হিসাব বেশি যুক্তিযুক্ত।
নব্য উদারতাবাদী মতবাদের মতে, এটাই সঠিক। মিল্টন ফ্রিডম্যানসহ নব্য উদার ব্যক্তিত্বরা আমাদের উপদেশ দিয়েছেন, করপোরেট ম্যানেজারদের কাজ হলো- মুনাফা কতটা বেশি করা যায়, সে জন্য চেষ্টা করা। এই নৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকে যেকোনো বিচ্যুতির ‘সভ্য জীবন’ ভিত্তিগুলোকে চুরমার করে দেবে।
কোভিড-১৯ সঙ্কট থেকে উত্তরণ ঘটবে মারাত্মক এমনকি ভয়াবহ মাশুল দিয়ে। বেশি ক্ষতির শিকার হবে গরিব মানুষরা এবং যারা বেশি ঝুঁকিতে আছে তারা। তবে মেরু অঞ্চলের বরফগলাসহ বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির ধ্বংসাত্মক পরিণাম থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ নেই। এ ক্ষেত্রেও বাজার বিপর্যয়ই দুর্যোগের কারণ এবং তার মাত্রা দুনিয়াটাকে দুলিয়ে দেয়ার মতো। বর্তমান (মার্কিন) প্রশাসনকে এখনকার মহামারীর ন্যায় সম্ভাব্য দুর্যোগ সম্পর্কে যথেষ্ট হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছিল। গত অক্টোবরে উচ্চপর্যায়ের সিমুলেশনও চালানো হয়েছে এ ব্যাপারে। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে গত কয়েক বছরে যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে এসেছেন, তাতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট সব অংশকে তহবিলবঞ্চিত করেছেন এবং ভেঙে দিয়েছেন। মুনাফাবাজিকে রুদ্ধ করে জীবন বাঁচাতে পারে- এমন সব বিধিবিধান উচ্ছেদের জন্য তিনি করপোরেট প্রভুদের নির্দেশ বাস্তবায়ন করছেন সর্বাত্মক উপায়ে। পরিণামে পরিবেশগত দুর্যোগ ঘনিয়ে এসেছে। এটা তার সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ; আসলে ফলাফল বিবেচনায় নিলে তা ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ অপরাধ।
গত জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে আর সন্দেহ রইল না, কী ঘটছে, সে ব্যাপারে। ৩১ ডিসেম্বর চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (হু) জানায়, নিউমোনিয়ার মতো লক্ষণ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে। চীন আরো জানায়, এ রোগের কারণ অজানা। ৭ জানুয়ারি চীন অবগত করে যে, বিজ্ঞানীরা এই ব্যাধির জন্য দায়ী করেছেন করোনাভাইরাসকে। তারা বিজ্ঞান জগতকে এ জীবাণুর জিনোম সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। গত জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ এ ভাইরাসের সংক্রমণের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কানে কথা তুলতে চেয়েছে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছেন এতে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রেসিডেন্টকে কোনো পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করা যায়নি। এ দিকে অবস্থার অবনতি হচ্ছিল।
ট্রাম্প নীরব ছিলেন না। তিনি সুনিশ্চিত ভঙ্গিতে বহুবার বক্তব্য দিয়েছেন। জনগণকে বলেছেন, এটা সামান্য কাশি মাত্র। সব কিছুই নিয়ন্ত্রণে আছে। যেভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছি, তাতে ১০-এর মধ্যে ১০-ই পাবো; এটা গুরুতর ব্যাপার। তবে এটা ভয়াবহ মহামারী, তা আমিই জানতে পেরেছি, ইত্যাদি। তিনি তার ব্যর্থতা প্রমাণ করেছেন। তার কৌশলটি সুচিন্তিত। তা হলো মিথ্যাকে এত দ্রুত বলে যাওয়া হবে যে, সত্যের ধারণাই মুছে যাবে। যাই ঘটুক না কেন, ট্রাম্প নিশ্চিত, তার অনুগত অনুসারীদের সমর্থন তিনি পাবেনই। এলোপাতাড়ি তীর ছুড়লে এর কোনোটা না কোনোটা টার্গেটে আঘাত হানার সম্ভাবনা থাকে।
ট্রাম্পের এমন রেকর্ডের মুকুটতুল্য ঘটনা হচ্ছে, ১০ ফেব্রুয়ারি যখন করোনাভাইরাসে দেশটা সয়লাব, তখন হোয়াইট হাউজ তার বার্ষিক বাজেট প্রস্তাব প্রকাশ করে। ফলে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট প্রধান প্রধান সরকারি ক্ষেত্রে বরাদ্দ আরো কমে গেল (আসলে জনকল্যাণমূলক সব কিছু হলো ক্ষতিগ্রস্ত)। অপর দিকে যা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ (সশস্ত্র বাহিনী ও দেয়াল) তার তহবিলের বহর বাড়ানো হয়েছে।
এর একটি ফল হচ্ছে, করোনার পরীক্ষা কাজ একেবারেই দেরিতে এবং সীমিত পরিসরে চলছে। এদিক দিয়ে আমেরিকা পিছিয়ে আছে। কোনো কোনো দেশ নিজেদের তৎপরতা দ্বারা এই মহামারীকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দেয়নি। কারণ তাদের পরীক্ষা ও অনুসন্ধান কৌশলটি সার্থক। যুক্তরাষ্ট্রে এর বাস্তবায়ন অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। এ দেশের এমনকি সর্বোত্তম হাসপাতালগুলোতেও মৌলিক যন্ত্রপাতি নেই। আর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রই করোনা সঙ্কটের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই পরিস্থিতি ট্রাম্পের অসৎ কর্মের সারাংশ মাত্র। এটা আর চলতে দেয়া যায় না।
সঙ্কটের মোকাবেলায় ব্যর্থতাজনিত বিপর্যয়ের জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করা আকর্ষণীয় ব্যাপার। তবে ভবিষ্যৎ বিপদ এড়াতে হলে তাকে ছাড়িয়ে প্রসারিত করতে হবে দৃষ্টি। তিনি একটি রুগ্ণ সমাজে ক্ষমতায় এসেছেন। এ সমাজ ৪০ বছর ধরে নব্য উদারতাবাদের হাতে যাতনা ভোগ করেছে। অবশ্য সমাজটার সমস্যার শেকড় আরো গভীরে।
নব্য উদার ধনতন্ত্র রিগ্যান-থ্যাচার আমল থেকে বহাল রয়েছে। এর সূচনা তার অল্প আগে। এর যে মন্দ পরিণাম তা বিশদ বলা নিষ্প্রয়োজন। রিগ্যান ছিলেন অতি ধনাঢ্য শ্রেণীর প্রতি বদান্য। অর্থনৈতিক সঙ্কট মুক্তির জন্য আরেকবার ‘বেইল আউট’ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। তাই তার কথাটা প্রাসঙ্গিক। ট্যাক্স হ্যাভেনের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, সেটা তুলে নেয়াসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রিগ্যান করের বোঝা জনগণের ঘাড়ে চাপিয়েছেন। স্টকের দাম ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা এবং কোম্পানিগুলোকে আরো ধনী বানিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সামর্থ্য ক্ষুণ্ন করার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, অত্যধিক সম্পদশালীরাই অধিকাংশ স্টকের মালিক। এসব নীতির প্রভাব পড়েছে ব্যাপকভাবে। আর্থিক বিচারে তা ২০, ৩০, ৪০ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। এ ধরনের পলিসি ক্ষুদ্র এক গোষ্ঠীকে লাভবান করলেও বাদবাকি সবাই ব্যর্থ। এভাবে আমরা এমন এক সমাজে আছি, যেখানে মাত্র ০.১ শতাংশের হাতে সম্পদের ২০ শতাংশ কুক্ষিগত।
জনগণের অর্ধেকই সম্পদহীন। তাদের বেঁচে থাকতে হয় নিছক বেতনের চেকের ওপর নির্ভর করে। অন্য দিকে কোম্পানির মুনাফা বেড়েছে বহুগুণ। আর প্রধান নির্বাহীদের বেতন হয়েছে আকাশছোঁয়া। এ দিকে প্রকৃত মজুরি হয়ে পড়েছে স্থবির। অর্থনীতিবিদ ইমানুয়েল সায়েজ এবং গাব্রিয়েল জুকম্যান ‘দ্য ট্রায়াম্ফ অব ইনজাস্টিস’ বইতে দেখিয়েছেন, শীর্ষ ব্যক্তিদের ছাড়া সব ইনকাম গ্রুপের ওপর ধার্যকৃত কর প্রায় অভিন্ন।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বেসরকারি ও মুনাফাভিত্তিক। এটা অনেক দিন যাবত আন্তর্জাতিক কেলেঙ্কারির বিষয়। এর মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ অন্যান্য উন্নত দেশের দ্বিগুণ। তবুও মার্কিন স্বাস্থ্যব্যবস্থার ফলাফল কখনো বা সর্বনিকৃষ্ট। নব্য উদারতাবাদী তত্ত্ব আরো এক আঘাত হেনেছে। এটা দক্ষতার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ের মাপকাঠির প্রবর্তন করেছে। তা হলো- মেদবিহীন সিস্টেমে একেবারে অনটাইম সার্ভিস। কোনো বিপর্যয় হলেই সিস্টেমটা ধসে পড়ে। নব্য উদার মূলনীতিভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বেলায়ও এ কথা সত্য।
ট্রাম্প উত্তরাধিকার সূত্রে এমন একটা বিশ্ব পেয়েছেন। আর এ বিশ্বই তার ‘পিটুনির ভেড়া’। বর্তমানে চলমান সঙ্কট উত্তরণের পর যে ধ্বংসস্তূপ পড়ে থাকবে তা থেকে একটি কার্যকর সমাজ পুনর্গঠনের বিষয়ে যারা উদ্বিগ্ন, তাদের জন্য বিজয় প্রসাদের এই আহ্বানে কান দেয়াই কল্যাণকর : ‘আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরব না। কেননা এই স্বাভাবিকই ছিল সমস্যা।’
প্রশ্ন : এখন যুক্তরাষ্ট্র জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা অতিবাহিত করছে। দীর্ঘকাল আমরা এমন হতে দেখিনি। এ পরিস্থিতিতেও আমেরিকার জনগণকে বলা হচ্ছে, সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিচর্যা বাস্তবসম্মত নয়। এই অবস্থার জন্য কি কেবল নব্য উদারতাবাদ দায়ী?
নোয়াম চমস্কি : এটা একটা জটিল কাহিনী। শুরুতেই বলা দরকার, বহু বছর ধরে নির্বাচনে দেখা গেছে, জনমত সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিচর্যার সপক্ষে। মাঝে মধ্যে এ সমর্থন প্রবল হতেও দেখা যায়। রিগ্যান আমলের শেষ বছরগুলোতে জনসাধারণের ৭০ শতাংশই ভেবেছিল মার্কিন সংবিধানে স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা প্রদান করা হবে। আর জনগণের ৪০ শতাংশের বিশ্বাস ছিল, সংবিধানে এর উল্লেখ ছিল আগে থেকেই। অর্থাৎ মার্কিন সংবিধানকে মনে করা হয়েছিল যা কিছু শুদ্ধ সঠিক তার ভাণ্ডার হিসেবে। রেফারেন্ডামগুলোতে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল। এর পরই শুরু হলো ব্যবসায়ের স্বার্থে আগ্রাসী প্রপাগান্ডা। তখন হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে, ‘করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হবে।’ এটা সম্প্রতি আমরা ঘটতে দেখলাম। এ অবস্থায় ইস্যুটিতে জনসমর্থন উবে গেল।
যা হয়ে থাকে আর কী। প্রপাগান্ডায় একটি সত্য ছিল। কর বাড়বে, তবে মোট ব্যয় অনেক কমে যাবে। তুলনীয় অন্য দেশগুলো এটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে। কত কমবে? এ ব্যাপারে কিছু ধারণার ব্যাপার আছে। ল্যান্সেট (ব্রিটেন) বিশ্বের অন্যতম নেতৃস্থানীয় মেডিক্যাল জার্নাল। এতে সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণামূলক লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ১৩ শতাংশ অর্থের সাশ্রয় করার সম্ভাবনা আছে এ ক্ষেত্রে। এতে বছরে বাঁচবে ৪৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি (২০১৭ সালে ডলারের দামের হিসেবে)।’
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, ‘কর্মচারীরা আর ঘনবসতির হিসাবে দেয় প্রিমিয়াম এবং বিদ্যমান সরকারি বরাদ্দ যা তার চেয়ে কম খরচে পুরো ব্যবস্থাটা পরিচালিত হতে পারে। এতে নিম্নআয়ের মানুষের সর্বাধিক স্বস্তির কারণ সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের হিসাবে সব আমেরিকানের স্বাস্থ্য পরিচর্যা এভাবে নিশ্চিত হলে প্রতি বছরে ৬৮ হাজার প্রাণ রক্ষা পাবে এবং সেই সাথে বাঁচবে ১৭ লাখ ৩০ হাজার জীবন বর্ষ।’ তবে এর ফলে কর বৃদ্ধি পাবে। মনে হয়, কর না দিতে হলে অনেক আমেরিকানই বেশি ব্যয় করার পক্ষপাতী। আর কর দেয়া মানে, বছরে হাজার হাজার মানুষের প্রাণনাশ। মার্কিন গণতন্ত্র এটাই ইঙ্গিত করছে। ব্যবসায়শক্তি আর তার বুদ্ধিবৃত্তিক দাসরা আলোচ্য পরিস্থিতির জন্য দায়ী। নব্য উদার হামলা আমেরিকার জাতীয় সংস্কৃতির এই ব্যাধিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এর শেকড়গুলো অনেক গভীরে প্রোথিত এবং এর অনেক রকম বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। বিষয়টি খুবই গুরুত্ববহ।
প্রশ্ন : কয়েকটি দেশ কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বেশি কৃতিত্ব দেখিয়েছে। এসব দেশ পাশ্চাত্যের (নব্য) উদারতাবাদী বিশ্বের বাইরে। এদের মাঝে রাশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া রয়েছে। এটা কি আমাদের পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো শিক্ষা দিচ্ছে?
নোয়াম চমস্কি : করোনাভাইরাসের সংক্রমণের নানা প্রতিক্রিয়া হয়েছে। প্রতীয়মান হয়, চীন এটাকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে, অন্তত কিছু সময়ের জন্য। চীনের চার পাশের দেশগুলোর ব্যাপারে কথাটা সত্য। এসব দেশে সংশ্লিষ্ট হুঁশিয়ারিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে প্রথমেই। এদের মধ্যে একাধিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আছে যারা পাশ্চাত্যের চেয়ে কম উন্নত নয়। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ এ ভাইরাস মোকাবেলায় তৎপরতা দেখালেও কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। এ দিকে কম মৃত্যুহারের দিক দিয়ে জার্মানি বিশ্বে রেকর্ড গড়েছে। এর হেতু হলো, বাড়তি স্বাস্থ্য সুবিধা ও রোগ নির্ণয়ের সামর্থ্য এবং পরিস্থিতির তাগিদে দ্রুত সাড়া দেয়া। নরওয়ের বেলাতেও এ কথা খাটে। ব্রিটেনে বরিস জনসনের প্রতিক্রিয়া ছিল লজ্জাকর। আর ট্রাম্পের আমেরিকা তো পেছনেই রয়ে গেছে।
জার্মানির উদ্বেগ তার রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে সীমিত। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) নিজের কার্যকারিতার প্রমাণ দিয়েছে। যা হোক, ইউরোপের রুগণ রাষ্ট্রগুলো সাহায্যের জন্য আটলান্টিকের এপারে পৌঁছতে পেরেছে। কিউবার বৃহৎ শক্তি আরেকবার প্রস্তুত ছিল তার ডাক্তার ও সরঞ্জাম নিয়ে। তার পড়শি যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনের জন্য স্বাস্থ্য সহায়তা কেটে দিচ্ছিল। এই ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্বাধিক ভয়াবহ মানবিক সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তার বাছাই করা শত্রুদের দুর্ভোগ চরমে তোলার জন্য নির্মম নিষেধাজ্ঞার নিগড় আরো কঠোর করার কাজে লাগাচ্ছে মারাত্মক স্বাস্থ্য সঙ্কটকে। কিউবা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে সর্বাধিককাল দুর্ভোগ পোহানো দেশ। সেই কেনেডি আমলের সন্ত্রাসবাদী লড়াই এবং অর্থনৈতিকভাবে টুঁটি টিপে ধরার দিনগুলো থেকে- তবে অলৌকিক উপায়ে কিউবা বেঁচে আছে। ওয়াশিংটনে যে ‘সার্কাস’ চলছে, এর সাথে জার্মানির অ্যাঞ্জেলা মের্কেলের পরিকল্পিত পদক্ষেপের তুলনা আমেরিকানদের মোটেও ভালো লাগে না। তিনি ঠাণ্ডা মাথায় বাস্তবের ভিত্তিতে জার্মানদের বলেছেন, কিভাবে এ মহামারী মোকাবেলা করা উচিত।
এ ক্ষেত্রে সাড়া দেয়ার বিষয়টি গণতান্ত্রিক বনাম স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। এটা হলো কার্যকর বনাম ব্যর্থ রাষ্ট্রের ব্যাপার। ট্রাম্প এসব দেশকে ‘মলমূত্রের মতো পরিত্যাজ্য’ বলে গালিগালাজ করে থাকেন এবং তাদের সাইজ করার জন্য ব্যস্ত রয়েছেন।
প্রশ্ন : দুই ট্রিলিয়ন ডলার করোনাভাইরাস অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী? আরেকটি মহামন্দা মোকাবেলা এবং মার্কিন সমাজের সর্বাধিক দুস্থ মানুষকে সাহায্যের জন্য তা পর্যাপ্ত কি না।
নোয়াম চমস্কি : এ পরিকল্পনা কোনো কিছুর চেয়ে উন্নত নয়। যাদের এ সাহায্যের নিতান্তই প্রয়োজন, এটা তাদের সীমিত সান্ত্বনা দেবে। যারা আসলেই দুস্থ তাদের সহায়তার জন্য প্রচুর অর্থ আছে এ তহবিলে। বিভিন্ন কোম্পানি বছরের পর বছর মুনাফার পাহাড় গড়ে এবং স্টক ব্যবসার মাধ্যমে তাকে অনেক বাড়িয়ে, ধাত্রী রাষ্ট্রের দুয়ারে ভিড় করেছে নিজেদের প্রকৃত স্বরূপ লুকিয়ে রেখে। তারা রাষ্ট্রীয় অর্থে তাদের উদ্ধার করে দিতে আবেদন জানাচ্ছে। উদ্বেগের হেতু নেই! বেকুবদের এই তহবিল তত্ত্বাবধান করবেন ট্রাম্প আর তার অর্থমন্ত্রী। তাকে ‘সত্য ও ন্যায়পরায়ণ’ বলে মেনে নেয়া যায়! তারা যদি নতুন ‘মহাপরিদর্শক’ আর কংগ্রেসের দাবিকে উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়, কে তখন পদক্ষেপ নেবে? ন্যায়বিচার বিভাগ? ইমপিচমেন্ট?
যাদের সাহায্য দরকার, তাদের সাহায্য করার পথ আছে। শ্রমজীবী মানুষের অনেকের আসলেই চাকরি ছিল। আবার বিপুলসংখ্যক মানুষের ছিল অস্থায়ী ও অনিয়মিত চাকরি। অনেকে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তদুপরি হতাশার মৃত্যু (Deaths of Despair) হচ্ছে আমেরিকার ট্র্যাজেডি। এর শিকার লাখ লাখ মানুষ যাদের ঘরবাড়ি নেই, যারা কারাবন্দী, যাদের গৃহসংস্থান এতই অপ্রতুল যে, আইসোলেশন এবং খাবার মজুদ করে রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আরো অনেকেই দুস্থ দরিদ্র যাদের চেনা কঠিন নয়।
দু’জন রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ টমাস ফার্গুসন আর রব জনসন সহজ ভাষায় বলেছেন, অন্যান্য দেশে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া স্বাভাবিক হলেও আমেরিকা এর আশা করা অনেক বেশি হয়ে যায়। কেন এ দেশে করপোরেশনগুলোর জন্য বীমার ক্ষেত্রে একতরফা সুবিধা থাকবে, তা বোধগম্য নয়।
করপোরেট সেক্টর থেকে বেইল আউটের জন্য স্টক বাইব্যাক নিষিদ্ধ করতে হবে কঠোরভাবে; ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকের অংশগ্রহণ হতে হবে অর্থবহ এবং তথাকথিত মুক্তবাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) বেলায় সংরক্ষণবাদী কেলেঙ্কারির অবসান ঘটানো দরকার। এ ধরনের চুক্তি বড় ওষুধ কোম্পানির বড় রকমের মুনাফার গ্যারান্টি দিলেও ওষুধের দাম যুক্তির সীমা ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে যায়।
সূত্র : নয়াদিগন্ত
আপনার মতামত জানানঃ