ভারতে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দার্শনিক নোয়াম চমস্কি। প্রখ্যাত মার্কিন লেখক নোয়াম চমস্কি বলেছেন, ইসলামোফোবিয়া সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ভারতে। এর ফলে দেশটির ২৫ কোটি মুসলিম নিপীড়িত সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি নিপীড়নে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের অবস্থাও এখন ফিলিস্তিনের মতো।
চমস্কি বলেছেন, পশ্চিমজুড়েই ‘ইসলামভীতিজনিত বিকার’ দিনে দিনে বাড়ছে। ভারতে এ বিকার চরম ও ভয়াবহ আকার নিয়েছে। সেখানে নরেন্দ্র মোদি সরকার ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করছে। ভারতকে একটি ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ রাষ্ট্রে পরিণত করার পথে হাঁটছে তারা।
ভারতে চলমান সাম্প্রদায়িক সংঘাত নিয়ে সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসনাল ব্রিফিংয়ে এক ভিডিও বার্তায় নিজের এই মতামত তুলে ধরেন নোয়াম চমস্কি। গত ৯ ফেব্রুয়ারি ‘ওয়ারসেনিং হেইট স্পিচ অ্যান্ড ভায়োলেন্স ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক এ কংগ্রেসনাল ব্রিফিংয়ের আয়োজক ছিল ১৭টি সংগঠন। এর মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জেনোসাইড ওয়াচ, ইন্ডিয়ান আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিল, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান কনসার্ন, দলিত সলিডারিটি ফোরাম ও হিন্দুজ ফর হিউম্যান রাইটস। এটি ছিল এক মাসের মধ্যে এ ধরনের তৃতীয় আয়োজন।
উল্লেখ্য, অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান বুদ্ধিজীবী এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) ইমেরিটাস অধ্যাপক।
প্রখ্যাত এই মার্কিন ভাষাতাত্ত্বিক ও দার্শনিক বলেন, কাশ্মীরে অপরাধের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এ অঞ্চলটি এখন নিষ্ঠুরভাবে দখলকৃত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। এখন এর অবস্থা হয়েছে অধিকৃত ফিলিস্তিনের মতো। এখনও এ যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা সমাধানের আশা ও সুযোগ রয়েছে, তবে তা খুব বেশিদিন থাকবে না।
পশ্চিমজুড়েই ‘ইসলামভীতিজনিত বিকার’ দিনে দিনে বাড়ছে। ভারতে এ বিকার চরম ও ভয়াবহ আকার নিয়েছে। সেখানে নরেন্দ্র মোদি সরকার ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করছে। ভারতকে একটি ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ রাষ্ট্রে পরিণত করার পথে হাঁটছে তারা।
ভারতের সংখ্যালঘু নিপীড়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ৯৩ বছর বয়স্ক ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কি বলেন, ‘ভারতে ইসলামভীতি মারাত্মক রূপ নিয়েছে। দেশটিতে বসবাসরত ২৫ কোটি মুসলিম জনগোষ্ঠী একটি নিপীড়িত সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এ দেশে নানা রূপে নিপীড়নের ঘটনা ঘটে চলেছে। স্বাধীন চিন্তার বিরুদ্ধে আক্রমণ এবং মূলত মুসলিমদের বিরুদ্ধে শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যবহার এর মধ্যে অন্যতম। তবে এখন নিপীড়নের পরিধি সেসব ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কাশ্মীরে ভারতের ভয়ানক অপরাধের চেয়ে নিপীড়নের এ ধারা আলাদা; এসব অপরাধের একটা দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদির ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী শাসনাধীনে নিপীড়নের এসব রূপের চরম বাড়বাড়ন্ত হয়েছে।’
এ আয়োজনে আরও বক্তব্য দেন ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর জন সিফটন। তিনি বলেন, মোদি সরকারের হিন্দুত্বের প্রসারের উদ্যোগ ভারতীয় সংবিধানের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের মৌলিক ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতা এবং দেশটির ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এর জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে। আরও ভয়ানক ব্যাপার হলো, ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নিরপেক্ষতা ক্রমে প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
এ মানবাধিকারকর্মী আরও বলেন, ভারতের যে নিজস্ব পরিচিতি—একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ, বহুত্ববাদী জাতিরাষ্ট্র হিসেবে ভারত সম্পর্কে যে প্রতিষ্ঠিত ধারণা—সেটিকে এই অধঃপতিত পরিস্থিতি হুমকির মুখে ফেলেছে। সেই সঙ্গে বিশ্বদরবারে একটি কার্যকর, অধিকারসচেতন গণতন্ত্রের বিষয়ে ভারতের অবস্থানকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য বক্তব্য ও সহিংসতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আয়োজিত এ ওয়েবিনারে আরও অনেক শিক্ষাবিদ ও অ্যাকটিভিস্ট অংশ নেন। ভারতীয় লেখক এবং ওয়েস্টমিনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার অন্নপূর্ণা মেনন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভারতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দিকে তাকানোর আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ, বিজেপি সরকারের অধীনে পরিস্থিতি ক্রমে উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে তিনি মত দেন।
তিনি বলেন, ২০২২ সালের এ ক’দিনেই চারজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া অনেক সাংবাদিক, বিশেষ করে নারী সাংবাদিকরা সহিংসতা ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে হয়রানি, অবৈধ আটকসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কাশ্মীরের পরিস্থিতি তো আরও ভয়াবহ। কারণ, সেখানে সাংবাদিকরা নিয়মিত পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ, রিপোর্টিংয়ে নিষেধাজ্ঞা, ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
এদিকে, ভারতে হিজাব বিতর্ক নিয়ে এবার মুখ খুলল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক সংস্থা বলেছে, কর্ণাটকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থি। তবে ভারত এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ রাশাদ হুসেইন টুইটে বলেছেন, ধর্মীয় স্বাধীনতা বলতে ধর্মীয় পোশাক বেছে নেওয়ার ক্ষমতাও বোঝায়। ভারতের কর্ণাটক রাজ্য ধর্মীয় পোশাকের অনুমতি নির্ধারণ করতে পারে না। স্কুলে হিজাব নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে এবং নারীদের তুচ্ছ করে তোলে। তবে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এটি দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১০
আপনার মতামত জানানঃ