জোট গড়ে, জোট ভাঙে এবং নির্বাচন এগিয়ে এলে জোট গঠন নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। চিত্রটা মোটামুটি এমনই বাংলাদেশে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ছোট ছোট দলের সাথে বৈঠক করছে, কথা বলছে। বিএনপি যে রাজনীতি করে, তার সাথে আদর্শিক মিল আছে জামায়াতে ইসলামির এবং সেই সম্পর্ক কিছুটা আড়ালে রাখলেও জামায়াত-বিএনপির ২০ দলীয় জোট অসক্রিয় থাকলেও ভেঙে যায়নি।
সম্প্রতি জামায়াতকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়েছে। মূলত দলটির আমীর ডা. শফিকুর রহমানের দেয়া একটি স্ট্যাটাস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতুহলের সৃষ্টি হয়।
পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে বিএনপি যেখানে সরকারের অনিয়ম ও ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরে সমালোচনা করছে, সেখানে তাদের মিত্র দল হিসাবে জামায়াতের আমীরের অনেকটা প্রশংসা সূচক স্ট্যাটাসকে সরকারের সাথে তাদের সখ্যতা বাড়ার ইংগিত বহন করে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
গত ২৫ জুন জামায়াতের আমীর স্ট্যাটাসে লেখেন ‘যুগ-যুগ ধরে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সাথে যাতায়াত ও যোগাযোগে সীমাহীন কষ্ট স্বীকার করে আসছিলেন। এমনকি মাঝে-মধ্যে ঢাকার উদ্দেশ্যে জরুরী চিকিৎসা নিতে আসা লোকদের কারো কারো মৃত্যু ফেরীঘাটেই হয়েছে। চিন্তা করলে যা খুবই হৃদয় বিদারক। আজ তাদের সে কষ্টের অনেকখানিই অবসান হলো। মহান রবের দরবারে এজন্য শুকরিয়া আদায় করছি, আলহামদুলিল্লাহ।’
সেতু নির্মাণে যার যেখানে যতটুকু অবদান কিংবা ভালো-মন্দ, তার বিচারের ভার জনগণের ওপর। পৃথিবীতে যা কিছুই কল্যাণকর হয়, তার জন্য মহান প্রভুর শুকরিয়া আদায় করাই হচ্ছে মানুষের দায়িত্ব। আর মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞচিত্ত মানুষ বিনয়ী হয়। বিনয় হলো- ভালো মানুষের পোশাক। মহান আল্লাহ্র দরবারে দো’য়া করি- জনগণের ভ্যাট, ট্যাক্সের অর্থ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের আর্থিক ও কারিগরি অংশগ্রহণে যে সেতু তৈরি হলো, তা জনগণের কল্যাণে নিবেদিত হোক। কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান, যানবাহনে উচ্চ হারের টোল যেন তাদের পুনর্বিবেচনায় স্থান পায়।’
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জামায়াতের আমীরের এই স্ট্যাটাসে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নেই। তবে রাজনীতিতে দলটির অবস্থান পরিবর্তনের কিছু ইঙ্গিত এতে রয়েছে কিনা তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। জামায়াতের বর্তমানে নিবন্ধন নেই। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শীর্ষ নেতাদের বেশির ভাগেরই মৃত্যুদণ্ড ইতিপূর্বে কার্যকর হয়েছে। এ অবস্থায় স্বভাবতই দলটির নেতারা পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে আমন্ত্রণ পাননি।
অন্যদিকে, বিএনপি নেতারা পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলেও যাননি। বরং দলটির অনেক নেতাই সেতুটি নির্মাণের অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছেন। এই পরিস্থিতিতে ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্য জামায়াতের একটি স্বতন্ত্র অবস্থানের ইঙ্গিত করে। এমনিতে অনেকদিন ধরেই বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। অনেকেই বলছেন, দল দু’টির মধ্যে এখন সে অর্থে যোগাযোগ নেই। জোটও রয়েছে নামকাওয়াস্তে।
এর আগে জামায়াত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এটা নিশ্চিত করেছিল যে, কোনো জোটে সম্পৃক্ত না থাকার ব্যাপারে একধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াত। এক্ষেত্রে দলটি স্বতন্ত্রভাবে এগুনোর চেষ্টা করবে। যদিও নির্বাচনী রাজনীতি থেকে দূরে থাকার ব্যাপারেও জামায়াতের ভেতরে একধরনের প্রবল মত রয়েছে।
এর আগে জামায়াত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এটা নিশ্চিত করেছিল যে, কোনো জোটে সম্পৃক্ত না থাকার ব্যাপারে একধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াত। এক্ষেত্রে দলটি স্বতন্ত্রভাবে এগুনোর চেষ্টা করবে। যদিও নির্বাচনী রাজনীতি থেকে দূরে থাকার ব্যাপারেও জামায়াতের ভেতরে একধরনের প্রবল মত রয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে চারদলীয় জোটের (পরে ২০ দলীয় জোট) অন্যতম প্রধান শরিক জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক দূরত্ব বেড়েছে বিএনপির। কিন্তু জামায়াত এই দূরত্বের কথা বরাবরই অস্বীকার করেছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে বিএনপির সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক কোনো দূরত্ব নেই। কৌশলগত কারণে বিএনপি ও জামায়াত উভয় দলই নিজেদের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশ্য তেমন কোনো তৎপরতা নেই। তবে ভোটের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী ফ্যাক্টর। সংগঠনটির সাংগঠনিক শক্তি যেমন আছে তেমনি আর্থিকভাবেও সংগঠনের অবস্থান জোরালো। মাঠ পর্যায়েও দলের সাংগঠনিক অবস্থান বেশ শক্ত এবং জনসমর্থনও আছে বলে দাবি জামায়াত নেতাদের।
বিএনপির সাথে জামায়াতে ইসলামীর দূরত্ব বাড়ছে এমন গুঞ্জন রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক দিন ধরে শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন বিএনপির সঙ্গে জামায়াতও বর্জন করে। শীর্ষ নেতাদের রক্ষা এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে জামায়াত-শিবিরের তৃণমূল নেতৃত্বকে কড়া মূল্য শোধ করতে হয়। রাজপথে নিহতের সংখ্যাও কম নয়। গ্রেফতার, রিমান্ড ছিল মামুলি ব্যাপার। সেই থেকে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক নিয়েও তৈরি হয় নানা আলোচনা-টানাপড়েন। আন্তর্জাতিক মহলের একটি অংশেরও আপত্তি লক্ষ্য করা যায় জামায়াতকে নিয়ে। বিএনপি নেতৃত্বও দৃশ্যত দুই ভাগ হয়ে যায়। একটি অংশ জামায়াতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়। নানা টানাপড়েন তৈরি হয় বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে। নিবন্ধন হারানো জামায়াত দৃশ্যত জোটে কোণঠাঁসা হয়ে পড়ে। এরপর ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে গড়ে ওঠা ঐক্যফ্রন্ট জামায়াতের গুরুত্ব একেবারেই কমিয়ে দেয়। যদিও শেষ পর্যন্ত সে নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে অংশ নেয় জামায়াত। ভোট কী ধরনের হয়েছে তা না বললেও সে নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের বিপর্যয়ের বিষয়টি সবার জানা। নির্বাচনে জামায়াত একটি আসনেও জয়লাভ করেনি।
ভোটের পর নতুন করে হিসাব-নিকাশ শুরু হয় জামায়াতে। মূলত গত সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কও অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়ে। সে বিষয়টি এখন আরও স্পষ্ট হচ্ছে। বিএনপি বর্তমান সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের প্রস্তুতির অংশ হিসাবে এরই মধ্যে ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দলের অংশ সংলাপ করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গে কোনো সংলাপ বা আলোচনা হয়নি। এ ব্যাপারে জামায়াতও নীরব।
স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ থাকলেও জিয়াউর রহমানের বদান্যতায় রাজনীতিতে ফেরার অনুমতি পাওয়া জামায়াত এখন দলীয় কার্যক্রম চালাতে পারলেও নির্বাচন কমিশনে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে।
২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২–এর আওতায় রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেয়া হয়। তবে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে করা ৬৩০ নম্বর রিট পিটিশনের রায়ে আদালত নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে। এরপর নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিল করে।
নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় দলীয় প্রতীকে ভোটে লড়ার যোগ্যতাও নেই জামায়াতের। অন্যদিকে তাদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের খড়্গ ঝুলছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের একাধিক রায়ে জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দেয়ার পর নেতাদের মতো দলটিরও বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। যদিও সেটি আট বছর আগের কথা। কিন্তু এর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বিভিন্ন সময়ে বলেছিলেন, অপরাধী সংগঠনের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের সংশোধনীর খসড়া শিগগিরই মন্ত্রিসভায় উঠবে। শেষ পর্যন্ত সেটা আর মন্ত্রিসভায় ওঠেনি। ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সংগঠনের বিচারকাজও শুরু করা যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকা ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগীর। দলটির নেতা-কর্মীরা সে সময় গঠন করে রাজাকার বাহিনী। তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ গঠন করে খুনে বাহিনী আলবদর। এই বাহিনীর বিরুদ্ধেই আছে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ। এসব ঘটনায়ই স্বাধীনতা-উত্তর জামায়াত হয় নিষিদ্ধ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ