দেশে করোনা সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ সাপ্তাহিক হিসাব বলছে, বিশ্বে সংক্রমণ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। এক সপ্তাহে বাংলাদেশে সংক্রমিত ব্যক্তি বেড়েছে ৩৫০ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২২ জুন এই তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২২ জুন সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৯ হাজার ২১৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৩১৯ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়। পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৩২ শতাংশ।
অর্থাৎ করোনার উপসর্গ নিয়ে ১০০ জন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করালে ১৪ জনের বেশি মানুষ করোনা রোগী বলে শনাক্ত হচ্ছে। করোনায় গতকাল বৃহস্পতিবারও একজনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই নিয়ে পরপর চার দিন একজন করে মৃত্যুর তথ্য দিল অধিদপ্তর। এর মধ্যে একজন চিকিৎসক।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলছে, করোনাভাইরাসের অমিক্রন ধরনই দেশে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। সবাই অমিক্রনেই আক্রান্ত হচ্ছে। এর একটি নতুন উপধরনও দেশে শনাক্ত হয়েছে। এই উপধরনে কতজন আক্রান্ত হয়েছে, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে একটি সূত্র বলছে, কমপক্ষে সাতজনের নমুনায় এই উপধরন শনাক্ত হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গত সপ্তাহে দেশে নতুনভাবে আক্রান্ত হয়েছিল ২ হাজার ২১২ জন। তার আগের সপ্তাহে ৪৯২ জন। এক সপ্তাহে বাংলাদেশে সংক্রমণ বেড়েছে ৩৫০ শতাংশ। একই সময়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে সংক্রমণ বৃদ্ধির হার ৬৫ শতাংশ। শতাংশের হিসাবে বাংলাদেশের পর সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধির হার পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশ ফিজিতে। এক সপ্তাহে ফিজিতে সংক্রমণ বেড়েছে ২৯৮ শতাংশ। ইউরোপ, আমেরিকা, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ বেড়েছে। তবে বাংলাদেশের মতো কোথাও বাড়েনি।
এক সপ্তাহ আগে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সংক্রমণ বৃদ্ধির ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। কমিটি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে জোর দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা জোরদার করার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিল। বলেছিল, করণীয় নির্ধারণে আন্তমন্ত্রণালয় সভা ডাকা দরকার। এর কোনো কিছু হয়েছে বলে জানা যায়নি।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যুও বাড়বে। জনস্বাস্থ্যবিদ ও আইইডিসিআরের পরামর্শক মুশতাক হোসেন বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। যাঁরা টিকা নেননি, এখনো বুস্টার ডোজ নেননি, তাঁদের দ্রুত তা নিয়ে নিতে হবে। অন্যদিকে হোটেল-রেস্তোরাঁ, গণপরিবহনে মাস্ক পরার ব্যাপারে জোর দিতে হবে।
ওমিক্রনের নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে বাংলাদেশি দুই জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের ওমিক্রন ধরনের নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট BA.4/5 শনাক্ত করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার জিনোম সেন্টারের একদল গবেষক যশোরের দুজন আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে সংগৃহীত ভাইরাসের আংশিক (স্পাইক প্রোটিন) জিনোম সিকুয়েন্সের মাধ্যমে করোনার নতুন এই উপধরণটি শনাক্ত করে।
যবিপ্রবির গবেষক দলটি জানায়, আক্রান্ত দুজন ব্যক্তিই পুরুষ। যাদের একজনের বয়স ৪৪ এবং আরেকজনের বয়স ৭৯ বছর। আক্রান্ত ব্যক্তির একজন করোনা ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ এবং অপরজন দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন।
আক্রান্তদের মধ্যে একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এবং আরেকজন বাসাতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। আক্রান্তদের শরীরে জ্বর, গলাব্যথা, সর্দি-কাশিসহ বিভিন্ন মৃদু উপসর্গ রয়েছে। তারা উভয়েই স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত হয়েছেন বলে গবেষকরা ধারণা করছেন।
গবেষক দলটি আরও জানায়, BA.4/5 সাব-ভ্যারিয়েন্টে স্পাইক প্রোটিনে ওমিক্রনের মতই মিউটেশন দেখা যায়। তবে তার সঙ্গে এই সাব-ভ্যারিয়েন্টে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মত স্পাইক প্রোটিনের ৪৫২ নম্বর অ্যামাইনো অ্যাসিডে মিউটেশন থাকে।
এছাড়াও এই সাবভ্যারিয়েন্টে স্পাইক প্রোটিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ৪৮৬ নম্বর অ্যামাইনো অ্যাসিডেও মিউটেশন দেখা যায়।
ওমিক্রনের এই দুইটি সাব-ভ্যারিয়েন্ট জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হয়েছে। গত মে মাসের শেষের দিকে দক্ষিণ ভারতে এই সাব-ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। এই উপধরণটি দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনা সংক্রমণের পঞ্চম ঢেউ এবং সাম্প্রতিককালে ভারতে করোনার তৃতীয় ঢেউ এর জন্য দায়ী বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
ভ্যাকসিন নেওয়া ব্যক্তিরাও এই সাবভ্যারিয়েন্ট দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। আগামী দিনে এই সাব-ভ্যারিয়েন্ট বর্তমানে সংক্রমণশীল অন্যান্য সাব-ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় বেশি সংক্রমণ ঘটাতে পারে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
করোনার এই নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের বিষয়ে যবিপ্রবির উপাচার্য ও জেনোম সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এই সাব-ভ্যারিয়েন্টটি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সহজেই ফাঁকি দিতে সক্ষম। এ জন্য মাস্ক ব্যবহারসহ কঠোরভাবে করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই।
তিনি জানান, অচিরেই পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকুয়েন্স করে এ বিষয়ে আরও তথ্য জানা সম্ভব হবে এবং এই সাব-ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তকরনের কাজ জিনোম সেন্টারে অব্যাহত থাকবে।
উল্লেখ্য যে, ইতোপূর্বে জিনোম সেন্টারে করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ও ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের স্থানীয় সংক্রমনও শনাক্ত করা হয়।
করোনা আপডেট
দেশে ফের বাড়তে শুরু করেছে করোনা সংক্রমণ। ২৪ ঘণ্টায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৩১৯ জন। শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৩২ শতাংশ।
একই সময়ে করোনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ২৯ হাজার ১৩৫ জনে। আর শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৯ লাখ ৬০ হাজার ৫২৮ জনে।
বৃহস্পতিবার (২৩ জুন) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
গত চার মাস পর দেশে দৈনিক করোনা শনাক্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করলো। এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এক হাজার ৪০৬ জনের করোনা শনাক্তের তথ্য দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এরপর সবশেষ বুধবার (২২ জুন) ফের হাজার ছাড়ায় করোনা সংক্রমণ। যা বৃহস্পতিবারও অব্যাহত রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন ১২৭ জন। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১৯ লাখ ৬ হাজার ২৩২ জন।
এছাড়া একই সময়ে দেশে ৯ হাজার ২১৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের শরীরে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর তথ্য জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ