৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে আমেরিকায় মূল্যস্ফীতি। এই বাস্তবতায় গত মার্চের পর তৃতীয়বারের মতো নীতি-নির্ধারণী সুদহারগুলি ব্যাপক হারে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় ফেডারেল রিজার্ভ। বুধবার ফেড সামনের মাসগুলোতে তা আরও বৃদ্ধির ইঙ্গিতও দিয়েছে।
আর দ্রুতই তার প্রতিক্রিয়া আসে ইউরোপ থেকে। বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যে হারে সুদহার বাড়িয়েছে তা ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৭০ সালের জ্বালানি তেল সংকটের প্রেক্ষিতে দেখা দেওয়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু দেশ এভাবে সুদহার বাড়িয়েছিল। ওই সময়ের পর এতটা সুদহার বৃদ্ধি ইউরোপের অনেক দেশেই হয়নি।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মহাদেশটির কোনো কোনো অংশে খাদ্য থেকে পরিষেবা; সবখাতে দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি হার ১১ শতাংশের দিকে যেতে থাকায় ব্যাংক অব ইংল্যান্ড খুবই সতর্কতার সাথে ঋণগ্রহণের খরচ এক-চতুর্থাংশ বাড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি-নির্ধারণী সুদহার বাড়ানোর চক্রবৃদ্ধি প্রভাব দেখা যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। ফলত; বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্য আনতে অন্যান্য উন্নত অর্থনীতিকেও তাদের সুদহার বাড়াতে হয়।
এতে ঋণগ্রহণ হয়ে পড়েছে আরও দামি। এ ধরনের পদক্ষেপে অন্যান্য মুদ্রার চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে ডলারের মান। ডলার যেভাবে শক্তিশালী হচ্ছে- তা বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির জন্য দুঃসংবাদ। বিশ্ববাণিজ্যের বেশিরভাগ পণ্যের মূল্য ডলারে নির্ধারিত হওয়ায়—জ্বালানি তেল, খাদ্য থেকে শুরু করে কাঁচামালের মতো সকল পণ্য আমদানির বিল আরও বাড়বে তার ফলে। বাণিজ্য ঘাটতি আরও প্রসারিত হবে আর তাতে উল্লম্ফন ঘটবে ভোক্তা মূল্যস্ফীতিতে।
অস্থির গোটা বিশ্বের অর্থনীতি
আমেরিকার মূল্যস্ফীতি রয়েছে ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮.৬ শতাংশে। এটি ২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ফেডের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির পদক্ষেপের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে মার্কিন পুঁজিবাজারে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ডাউ জোন্স গড় শিল্পসূচক কিছুটা কমার পর শক্তিশালীভাবে বেড়েছে।
মার্কিন মুদ্রাকে প্রতিযোগী ছয়টি মুদ্রার সাথে তুলনার গ্লোবাল ডলার ইনডেক্স শেষপর্যন্ত দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১০৫.৮ পয়েন্ট। ইয়েন ও ইউরো উভয়ের বিপরীতেই উল্লম্ফন ঘটেছে ডলারের।
পণ্যবাজারে খাড়া পতন থেকে পুনরুদ্ধার হয়েছে তেলের মূল্য। ব্যারেলপ্রতি ব্রেন্ট ক্রুডের লেনদেন শেষ হয়েছে ১১৮.৮৩ ডলার এবং ইউএস ক্রুডের ১১৫.৮৮ ডলারে। ডলার শক্তিশালী হওয়ায় কিছুটা কমে প্রতিআউন্স ১,৮৩১.২৬ ডলার হয়েছে স্বর্ণের মূল্য।
জ্বালানি, খাদ্যশস্য, শিল্পকাজে ব্যবহৃত ধাতু, মূল্যবান ধাতু, চিনি, কফি, তুলা ও প্রানী-সম্পদসহ বহুবিধ পণ্যমূল্য বাড়া-কমার একটি প্রধান সূচক- ব্লুমবার্গ কমোডিটি ইনডেক্স। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এটি আগের দিনের চেয়ে ১ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়ে হয় ১৩০.১৫।
বিএনওয়াই মেলন সংস্থার জ্যেষ্ঠ ইমইএ বাজার কৌশলবিদ জিউফ্রে ইউ মার্কিন গণমাধ্যম সিএনবিসিকে বলেন, “বৈশ্বিক পণ্যমূল্য ডলারে নির্ধারিত হয়। তাই অন্য দেশগুলির দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান পরিস্থিতিতে শক্তিশালী ডলার তাদের কারো কাম্য নয়।”
হোক সে জাপান, সুইজারল্যান্ড বা উদীয়মান কোনো বাজার অর্থনীতি- বাণিজ্যের উপর অতি-নির্ভরশীল সব দেশেই এর প্রভাব পড়বে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশের চেয়ে বৈশ্বিক আর্থিক বাজারের সাথে বেশি সম্পৃক্ত থাকার পরও, প্রতিবেশী ভারতে মূল সূচকগুলো ঊর্ধ্বমুখী নিয়ে লেনদেন শুরু হয়। ভারতের আর্থিক বাজারে এখন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বিদেশি পোর্টফলিও, বন্ড ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ঘিরে। কারণ ফেডের পদক্ষেপ আমেরিকার দেনার বাজারে উচ্চ লভ্যাংশ দিলে ভারতে ডলারে বিনিয়োগ প্রবাহ কমার আশঙ্কা রয়েছে।
এই উদ্বেগকে সমর্থন করছে ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে, ঊর্ধ্বমুখী মার্কিন সুদহার এশিয়ার মুদ্রাগুলির ওপর নিম্নমুখী চাপ সৃষ্টি করেছে, ফলে এই অঞ্চল থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে নিয়ে যাওয়া হবে। তাই প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাধ্য হয়েই এখন নিজেদের অর্থায়নের বেঞ্চমার্ক বাড়াতে হবে এ অঞ্চলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে।
বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি এশিয়ায় কিছুটা ভিন্ন রূপ নেওয়ায় কিছুক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা আরও সংযত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে ফেড বৈশ্বিক পর্যায়ে চাপ বাড়িয়েই চলেছে। থাইল্যান্ডে মূল্যস্ফীতি ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ থাকার পরও দেশটি তাদের বেঞ্চমার্ক সুদের হার গত দুই বছর ধরে অপরিবর্তিত রেখেছে।
অন্যদিকে, রাতারাতি নীতি-নির্ধারণী সুদহার বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে মালয়েশিয়া। তবে খুব শিগগির সুদহার বৃদ্ধির বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি দক্ষিণ কোরিয়া।
উচ্চমূল্য, আমদানি খরচ মেটানো এবং বৈদেশিক দেনা পরিশোধে দেশ থেকে ডলার চলে যাওয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকলে বাংলাদেশও মুদ্রাবাজারে সম্ভাব্য অভিঘাতের শিকার হবে।
বাংলাদেশের জন্য কেন ক্ষতিকর?
ডলারের বিনিময় দর নির্ধারিত সীমায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরমধ্যেই জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে কিছু কিছু ব্যাংক আমদানিকারকদের ঋণপত্র খুলতে ৯৩ টাকায় মূল্যে প্রতিডলার বিক্রি করছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার মান কয়েকবার কমিয়ে গত মঙ্গলবার ৯২.৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
বৃহস্পতিবার আবার ডলারের দর বেড়ে ৯২.৮৫ টাকায় পৌঁছালে, দ্রুত ব্যবস্থা হিসেবে ২৮ মিলিয়ন ডলার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মার্কিন ডলারের বাড়তি চাহিদা তারা যেন পূরণ করতে পারে সেজন্যই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
এর আগে বুধবার ৬৪ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এপর্যন্ত বাজারে সরবরাহ করেছে ৭০০ কোটি ডলার।
তবে আমদানিকারকরা বলছেন তারা বেশিরভাগ ব্যাংকের কাছ থেকে এই দরে ডলার কিনতে পারছেন না। ব্যাংকাররা যুক্তি দিচ্ছেন যে, রপ্তানিকারকরা তাদের রপ্তানি আয়ের ডলারের বেশি দর চাইছেন, ফলে তাদের পক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে সম্মতি হওয়া দরে ডলার বেচাকেনা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
গত সপ্তাহে আন্তঃব্যাংক কলমানি রেট রাতারাতি বেড়ে দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫.০২ শতাংশে পৌঁছায়। বৃহস্পতিবার সপ্তাহ শেষ হওয়া পর্যন্ত এ দর বজায় ছিল।
ডলারের দর আরও বাড়লে তারল্য চাহিদায় ভোগা ব্যাংকগুলিকে আরও অর্থ ধার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে হবে। এতে কলমানি রেট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা।
অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ফেডের সুদহার বৃদ্ধির ফলে বিশ্বব্যাপী ডলারের চাহিদা বাড়বে। এতে বিশ্বের প্রায় সকল দেশের স্থানীয় মুদ্রার মানের অবনমন হবে।
শেয়ার, পোর্টফলিও এবং এমনকী সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে নিয়োজিত বিপুল পরিমাণ ডলার উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলি থেকে আমেরিকা চলে যাবে বলে সতর্ক করেন তিনি।
আমেরিকা ও ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সুদহার বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ কী করতে পারে?
ডলার খরচ কমাতে ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নীতিনির্ধারণী সুদহার বৃদ্ধি কি উপযুক্ত সমাধান? বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মো. হাবিবুর রহমান বলেন, মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের প্রভাব এরমধ্যেই বিশ্ববাজারে পড়েছে। তবে এটি মারাত্মক হবে না বলেই আশা করছেন তিনি।
ফেডের সিদ্ধান্তে বাজার প্রতিক্রিয়া উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরমধ্যেই মার্কিন পুঁজিবাজার খাড়া পতনের শিকার হয়েছে, চীন ও জাপানেও শেয়ারমূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বিল ও বন্ডসহ সব ধরনের সুদহার ঋণ পরিশোধকে ব্যয়বহুল করে তুলবে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের জন্যেও উদ্বেগের কারণ হওয়ায়, মো. হাবিবুর রহমান বলেন, “আমাদের ক্রমবর্ধমান আমদানি খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় বের করতে হবে।”
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৩৫
আপনার মতামত জানানঃ