একের পর এক সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে এশিয়ার পরাশক্তিধর দেশ পাকিস্তান। কিছুদিন আগেই ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে উৎখাতে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট দেশটিকে প্রায় অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ইমরানের পতনের পর শাহবাজ শরিফ নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরু হয়েছে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট।
শ্রীলঙ্কার পথেই হাঁটছে যেন দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তান! দিন যত যাচ্ছে, বিদেশি ঋণে জর্জরিত দেশটির অর্থনীতি তত বেহাল হচ্ছে। রিজার্ভ ফাঁকা হতে হতে একেবারে শেষের পথে রয়েছে। সব মিলিয়ে দু’মাসও চলার উপায় নেই এই রিজার্ভ দিয়ে। ফলে আমদানিতে লাগাম টানতে হচ্ছে ইসলামাবাদকে।
এখন নতুন করে অর্থনীতি বাঁচাতে জনগণের ঘারে বোঝা তুলে দিচ্ছে পাক সরকার।বেহাল এই অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় দেশটির বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বৃহস্পতিবার আরেক দফা পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি করেছে। দেশটিতে এখন প্রতি লিটার পেট্রোল ২৩৪, ডিজেল ২৬৩ আর কেরোসিন ২১২ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে।
এর পাশাপাশি পাকিস্তানি রুপির দরে একের পর এক পতন ঘটেছে। একই দিনে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে পাকিস্তানি ২০৭ রুপির বিনিময়ে মিলছে ১ ডলার। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানি রুপির এমন পতন কখনোই দেখেনি দেশটি।
এমন পরিস্থিতিতে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, দেউলিয়া হয়ে যাওয়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার পথে রয়েছে পাকিস্তান।
ইমরান খান বলেন, পাকিস্তানের রপ্তানি আজ ১০ শতাংশ কমে গেছে। স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে বেরিয়ে গেছে ৭০০ বিলিয়ন রুপি। পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পর্কে রেটিংও কমিয়েছে বিশ্বের শীর্ষ ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠান মুডিস। তিনি বলেন, দেশ শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতির পথে রয়েছে। এই দেশকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় আগাম ও স্বচ্ছ নির্বাচন।
তবে দেশটির এমন অবস্থায় পাকিস্তানের বর্তমান সরকার দুষছে সাবেক ইমরান খানের সরকারকে। সেই সরকারের নীতির কারণেই আজ পাকিস্তানের এই দশা। ইসলামাবাদে সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী মিফতা ইসমাইল অভিযোগ করেন, ইমরানের সরকারের নীতির কারণে পাকিস্তানের আজকের এই বেহাল দশা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভর্তুকি দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে পেট্রোলের দাম কমিয়েছিলেন এবং বর্তমান সরকারকে সেই সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হচ্ছে।
বেহাল এই অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় দেশটির বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বৃহস্পতিবার আরেক দফা পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি করেছে
মন্ত্রী মিফতাহ ইসমাইলের মতে, পাকিস্তান প্রতি লিটার পেট্রোলে ২৪.০৩ টাকা, ডিজেলে ৫৯.১৬ টাকা, কেরোসিন তেলে ৩৯.৪৯ টাকা এবং লাইট ডিজেল তেলে ৩৯.১৬ টাকা ক্ষতি বহন করছে। মে মাসে জ্বালানি তেল বিক্রির থেকে যে ক্ষতি হয়েছে, তার পরিমাণ ১২০ বিলিয়ন রুপি ছাড়িয়েছে।
এদিকে ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠছে পাকিস্তানের বিদ্যুৎ সংকট। জ্বালানির অভাবে দেশে বিদ্যুৎ তৈরি করা যাচ্ছে না। আর তার ফলে ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে ব্ল্যাক আউটের সময়সীমা। যা বাড়তে বাড়তে পৌঁছে গিয়েছে ১২ ঘণ্টায়। এই পরিস্থিতি মনে করিয়ে দিচ্ছে শ্রীলঙ্কার কথা। সেখানে মাস তিনেক আগে এমনই তীব্র বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছিল। এদিকে আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে পাক প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছে, আগামী দিনে ব্ল্যাক আউটের সময়সীমা আরও বাড়ানো হতে পারে।
এদিকে ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির নজিরবিহীন দর পতন ঘটেছে। আগের সব রেকর্ড ভেঙে বৃহস্পতিবার আরেক দফা নেমেছে পাকিস্তানি রুপির মান। বর্তমানে পাকিস্তানের মুদ্রাবাজারে ২০৭ রুপির বিনিময়ে মিলছে ১ ডলার।
দেশটির ইংরেজি দৈনিক ডন বলছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাথে পাকিস্তানের চুক্তির বিষয়ে অস্পষ্টতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যাপক কমে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার সকালের দিকে মার্কিন ডলারের দর পতনের আরেকটি রেকর্ড হয়েছে।
গত মে মাস থেকে হু হু করে হ্রাস পেতে শুরু করে পাকিস্তানি রুপির মান। ১৯ মে পাকিস্তানে ১ ডলারের বিপরীতে রুপির মান পৌঁছায় ২০০-তে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর গত ৭৫ বছরের ইতিহাসে নিজেদের মুদ্রার এই পরিমাণ পতন দেখেনি পাকিস্তান।
তবে সেখানেই থেমে থাকেনি রুপির দরপতন, বরং দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নেমেছে মান। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত পাকিস্তানে ১ ডলারের বিপরীতে রুপির মান ছিল ২০৫ দশমিক ২৫। বুধবার তা আরও নেমে পৌঁছায় ২০৬ দশমিক ৫০ রুপিতে।
আর বৃহস্পতিবার সকালের দিকে তা আগের সব রেকর্ড ভেঙে ২০৭ রুপিতে পৌঁছেছে। তবে খোলা বাজারে আজ ২০৮ দশমিক ৫ রুপিতে মিলেছে ১ ডলার।
মেট্টিস গ্লোবালের পরিচালক সাদ বিন নাসির বলেন, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ প্রকল্প স্থবির অবস্থায় থাকা, জঙ্গিবাদে অর্থায়ন পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) ধূসর তালিকায় থাকা, চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের চাপ ও জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য— এই চার কারণে ব্যাপক চাপে রয়েছে পাকিস্তানের অর্থনীতি। আর তার ফলাফলই হলো রুপির এই ধারাবাহিক দরপতন।
ডন বলছে, ২০১৯ সালের জুলাইয়ে আইএমএফের সঙ্গে একটি ঋণচুক্তি করেছিল পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পিটিআই সরকার। সেই চুক্তি অনুযায়ী, পাকিস্তানকে সাড়ে তিন বছর (৩৯ মাসে) কিস্তিতে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আইএমএফ।
তবে তার বিপরীতে আইএমএফের কিছু শর্ত ছিল। এসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত ছিল যে, সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের জ্বালানি খাতে কোনো ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। কিন্তু পিটিআই সরকার ২০২১ সালের শুরুর দিকে জ্বালানিতে ভর্তুকি বিষয়ক শর্ত অমান্য করায় ৩০০ কোটি ডলারের ঋণ ছাড়ের পরই সেই প্রকল্প থামিয়ে দেয় আইএমএফ।
এশিয়ার আরেক দেশ শ্রীলঙ্কাও একই বাস্তবতায় হাঁটছে। ঋণ সংকটে জর্জরিত দেশটিতে রাজনৈতিক পালাবদল শুরু হয়েছে। লঙ্কান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসেকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বাস্তবতাও কাছাকাছি। এজন্যই বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার পথ ধরেই হাঁটছে পাকিস্তান। শ্রীলঙ্কাকে রক্ষা করতে প্রতিবেশী দেশ ভারত কিছুটা এগিয়ে এলেও, পাকিস্তানকে রক্ষায় কোনো প্রতিবেশীই এগিয়ে আসছে না। কারণ দেশটির বিরুদ্ধে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই এক অভিযোগের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মতো মিত্রও পাকিস্তানের প্রতি বিমুখ হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৬
আপনার মতামত জানানঃ