পৃথিবীর বাইরে কি কোনও জীবন রয়েছে? বিজ্ঞানীরা ভিনগ্রহে জীবনের অনুসন্ধান করেই চলেছেন নিরন্তর।
বেশ কিছুদিন ধরেই ধারণা করা হত পৃথিবীতে গ্রহাণুর মাধ্যমে সৌরজগতের বাইরে থেকে প্রাণ এসেছে। কিন্তু গ্রহাণু কি লাখো বছর ধরে প্রাণ সংরক্ষণ করতে এবং তা সফলভাবে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে সক্ষম?
পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার নিয়ে আলোচনা–বিতর্ক অনেক দিনের। পৃথিবীতে বাইরে থেকে প্রাণের আগমন হয়েছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রাখেন অনেকে। সেই প্রশ্নটি আরও জোরালো করে তুলল গ্রহাণুর নমুনা। ওই নমুনাতে পৃথিবীতে পাওয়া যায়, এমন কিছু জৈব উপাদান পাওয়া গেছে, যেগুলো মহাকাশে গঠিত হয়ে থাকতে পারে।
গতকাল শুক্রবার (১০ জুন ২০২২) বিজ্ঞানীরা এমন দাবি করেছেন। জাপানের মহাকাশ পর্যবেক্ষণকারী একটি যান গ্রহাণুর ওই ক্ষুদ্র নমুনা সংগ্রহ করে।
রিয়ুগু নামের গ্রহাণু থেকে আসল উপাদানটি ২০২০ সালে পৃথিবীতে আনা হয়। ছয় বছর মিশন পরিচালনার পর প্রায় ৩০ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে সেটি পৃথিবীতে আনা হয়। এরপর চলে পরীক্ষা–নিরীক্ষা। মাত্র ৫ দশমিক ৪ গ্রামের ওই ক্ষুদ্র শিলার কিছু অংশ নিয়ে গবেষণা করেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু গ্রহাণুর উপাদান নিয়ে প্রথম গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এর রহস্য ভেদ করার কাজ শুরু করেন।
ওই বিষয়ে জাপানের পশ্চিমাঞ্চলের ওকায়ামা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বাধীন একদল গবেষকের একটি গবেষণা নিবন্ধ গতকাল প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা নিবন্ধে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, গ্রহাণুর নমুনায় তারা অ্যামিনো অ্যাসিডসহ অন্যান্য জৈব পদার্থ আবিষ্কার করেছেন, যা থেকে পৃথিবীতে প্রাণের উৎসের সূত্র মিলতে পারে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, প্রোটিন গঠনকারী অ্যামিনো অ্যাসিডের আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, উল্কাপিণ্ডের মতো রিয়ুগু পৃথিবীর জীবজগতের সংস্পর্শে আসেনি। তাই রিয়ুগুতে অ্যামিনো অ্যাসিড শনাক্ত হওয়ায় এটা প্রমাণ করে যে পৃথিবীতে জীবনের প্রাথমিক সূত্র মহাকাশের কোনো পরিবেশে কোথাও গঠিত হতে পারে।
জাপানের হায়াবুসা-২ নামের নভোযানে করে যে গ্রহাণুর নমুনা আনা হয়েছিল, তাতে ২৩ ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড খুঁজে পাওয়ার কথা বলেছেন গবেষকেরা।
জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জেএএক্সএ) এক বিবৃতিতে বলেছে, এখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া উল্কাসহ যেকোনো প্রাকৃতিক নমুনার মধ্যে রিয়ুগুতে সবচেয়ে আদিম বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, সৌরজগতের উৎপত্তি হওয়ার প্রায় ৫০ লাখ বছর পরে গ্রহাণুর উপাদানের অংশ তৈরি হয়েছিল এবং ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উষ্ণ হয়নি।
রিয়ুগুতে অ্যামিনো অ্যাসিড শনাক্ত হওয়ায় এটা প্রমাণ করে যে পৃথিবীতে জীবনের প্রাথমিক সূত্র মহাকাশের কোনো পরিবেশে কোথাও গঠিত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সায়েন্স সাময়িকীতে আরেকটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই উপাদানে একটি রাসায়নিক সংমিশ্রণ রয়েছে, যা অন্যান্য প্রাকৃতিক নমুনার তুলনায় সূর্যের আলোকমণ্ডলের সঙ্গে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ।
জাপানের ইয়োকোহামা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একজন অ্যাস্ট্রোবায়োলজি বিশেষজ্ঞ এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক কেনসেই কোবায়াশি এই আবিষ্কারকে বিস্ময়কর বলে স্বাগত জানিয়েছেন।
কেনসেই কোবায়াশি বলেন, অ্যামিনো অ্যাসিডসহ জৈব পদার্থ কীভাবে তৈরি হয়েছিল বা এটি কোথা থেকে এসেছে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে নানা প্রশ্ন রয়েছে। গ্রহাণুর নমুনায় অ্যামিনো অ্যাসিড শনাক্ত হওয়ায় এটি মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে এসেছে, তা ভাবার সুযোগ করে দেবে।
গ্রহাণুকে বলা যায় সৌরজগত সৃষ্টির ইঁট-পাথর। সৌরজগতে পৃথিবীর মত পাথুরে গ্রহগুলো যে ধরণের শিলা দিয়ে তৈরি— এই গ্রহাণুগুলোও তৈরি সেই একই শিলা দিয়ে।
কিন্ত এগুলো কোন কারণে সূর্যের চারদিকে ঘুরতে থাকা কোন গ্রহের সাথে জোড়া লেগে যায়নি, বরং আলাদা ভাবেই মহাশূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এগুলোর মধ্যে আবার রিয়ুগু হচ্ছে একটি বিশেষ শ্রেণীর গ্রহাণু— যা সবচেয়ে প্রাচীন শ্রেণীর মহাজাগতিক পাথর।
এগুলোকে বলে সি-টাইপ বা ‘কার্বনেশিয়াস এ্যাস্টরয়েড’।
ধারণা করা হয়, সৌরজগতের জন্মের প্রথম দিকে পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির জন্য পানিসহ আরো যেসব উপাদান দরকার তা হয়তো এইসব গ্রহাণু থেকেই এসেছিল।
২০১৮ সালে যখন জাপানি মহাকাশযান হায়াবুসা-টু রিয়ুগুতে পৌঁছায়, তখন এর কুচকুচে কালো রঙ দেখে বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
একারণে মহাকাশযানটি যখন গ্রহাণুটির উপরিতলের কাছাকাছি যায়, তখন নিয়ন্ত্রণকারীদের লেজার সেন্সরগুলোকে এমনকি নতুন করে উচ্চতা মেপে নিতেও হয়েছিল।
প্যানসপারমিয়া ভাবনা অনুযায়ী, জীবনের উৎপত্তি পৃথিবীতে নয়; বরং অন্য কোথাও। সেখান থেকেই মহাবিশ্বে জীবন ছড়িয়ে যায়। বিভিন্ন গ্রহাণু, উল্কা ও ধূমকেতুর মাধ্যমে এই জীবন বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মতে, প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে অজানা কোনো স্থান থেকে জীবনের উপাদান পৃথিবীতে এসে পড়ে। সম্প্রতি মহাকাশবিদদের কাছে এই তত্ত্ব ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে।
অনেক বিজ্ঞানী ধারণা করেন, সমগ্র মিল্কি ওয়ে জুড়েই প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। গবেষকরা বলছেন, জীবনধারী অন্যান্য গ্রহের মতো পৃথিবী থেকেও মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জীবন্ত উপাদান স্থানান্তর হয়। আর এভাবেই হয়ত অতীতে পৃথিবীতে প্রাণ এসেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১২
আপনার মতামত জানানঃ