জাতিগত বিদ্বেষ বা বর্ণবাদ তথা বর্ণবৈষম্য এমন এক বিষাক্ত মতবাদ যা যুগে যুগে মানব-সভ্যতা এবং মানব-ইতিহাসকে করেছে কলঙ্কিত। আধুনিক যুগও এই কলঙ্কজনক মতবাদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি। লজ্জাজনক হলেও এটা এক জ্বলন্ত বাস্তবতা।
কথিত পশ্চিমা সভ্যতা সাম্য, স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বুলি আওড়াতে অভ্যস্ত হলেও সেখানেও বর্ণবাদ ও বর্ণবিদ্বেষ ক্রমেই বাড়ছে। আর সব ধরনের লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে এই কথিত পশ্চিমা সভ্যতার ধ্বজাধারীরাই গোটা মধ্যপ্রাচ্যে জাতিগত বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ হিসেবে গড়ে তুলেছে দখলদার ইসরায়েলকে। পাশ্চাত্যে মুসলমান ও কালো বর্ণের বা অশেতাঙ্গ নাগরিকরা প্রায়ই নিহত বা নাজেহাল হচ্ছে বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠী, শ্বেতাঙ্গ পুলিশ উগ্র ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর সমর্থকদের হাতে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটলেও আজও যুক্তরাজ্যে বর্ণবাদের অবসান ঘটেনি।
আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, যুক্তরাজ্যে আটক আফ্রিকান শরণার্থীরা যাদের রুয়ান্ডায় নির্বাসিত করার কথা রয়েছে তারা বলেছেন যে, তারা অনশনে রয়েছেন কারণ তারা গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থার সাথে লড়াই করছেন, একজন বলেছেন যে, তার আত্মহত্যার চিন্তা রয়েছে।
যুক্তরাজ্য এপ্রিলে আফ্রিকান আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য একটি বিতর্কিত পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে ঢোকা আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডায় পাঠাতে গত ১৪ এপ্রিল দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়েছে৷ সে অনুযাযী রুয়ান্ডায় প্রথম নির্বাসন ফ্লাইট ১৪ জুন যাত্রা শুরু করবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পরিকল্পনার মাধ্যমে কালোদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে। কারণ, শুধুমাত্র শেতাঙ্গ বলে ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা সেখানে বসবাসের সুযোগ ও নাগরিকত্ব পাচ্ছে। অথচ, কালো বলে আফ্রিকান শরণার্থীদের রুয়ান্ডায় নির্বাসিত করা হচ্ছে, যেখানে তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। কারণ দেশটিতে ১৯৯৪ সালে প্রায় ৮ লাখ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন।
শুধুমাত্র শেতাঙ্গ বলে ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা সেখানে বসবাসের সুযোগ ও নাগরিকত্ব পাচ্ছে। অথচ, কালো বলে আফ্রিকান শরণার্থীদের রুয়ান্ডায় নির্বাসিত করা হচ্ছে, যেখানে তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে।
সিরিয়া থেকে আহমেদ (ছদ্ম নাম) বলেছেন, সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকার করার পর তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং নথি ছাড়াই যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন। প্রথম ফ্লাইটেই তাকে ফেরত পাঠানো হবে।
লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরের কাছে কলনব্রুক ইমিগ্রেশন রিমুভাল সেন্টারে আটক ২০ বছর বয়সী এই যুবক ফোনে আল জাজিরাকে বলেছেন, তিনি এই পদক্ষেপের প্রতিবাদে অনশন করছেন এবং ভাষা ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে কেন তাকে রুয়ান্ডায় পাঠানো হচ্ছে তা বুঝতে পারছেন না।
একই কেন্দ্রে ইরান থেকে ২৩ বছর বয়সী কুর্দি বন্দী ফেরহাদ (ছদ্ম নাম) বলেছেন, ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের ইউরোপীয় স্বাগত জানানোর সাথে তুলনা করলে তাদের উপরে বৈষম্য করা হচ্ছে।
‘যখন ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন সমস্ত ইউক্রেনীয়কে স্বাগত জানানো হয়েছিল এবং উন্নত চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল,’ তিনি বলেছিলেন, ‘যেহেতু আমরা সবাই শরণার্থী, আমি বুঝতে পারিনি কেন আমাদেরকে রুয়ান্ডায় স্থানান্তর করা হবে যখন ইউক্রেনীয়দের স্বাগত জানানো হবে, তাদের একটি উন্নত জীবন, আশ্রয় এবং প্রয়োজনীয় সবকিছু দেয়া হবে।’
আল-জাজিরা কলনব্রুকের ১৫ জন বন্দীর সাথে কথা বলেছে, যেখানে ৬০ জনেরও বেশি লোককে রুয়ান্ডায় নির্বাসনের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। লন্ডনের কাছাকাছি অন্যান্য আটক কেন্দ্রে আরও অনেককে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।
আল-জাজিরা সামগ্রিকভাবে কতজনকে নির্বাসিত করা হবে তা জানতে হোম অফিসের সাথে যোগাযোগ করেছিল, তবে বিভাগের একজন মুখপাত্র মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র সচিব প্রীতি প্যাটেল, যিনি রোয়ান্ডার সাথে কিগালিতে শরণার্থীদের স্থানান্তর করার জন্য বহু মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন, তিনি এই ব্যবস্থাটিকে ক্রমবর্ধমান অনিয়মিত অভিবাসীদের প্রক্রিয়া করার একটি কার্যকর উপায় হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
তিনি আরও দাবি করেন যে, এটি পাচার রোধ করবে এবং ইংলিশ চ্যানেলে মৃত্যু হ্রাস করবে।
তবে অধিকারকর্মীরা বলেছেন যে, নির্বাসনের পদক্ষেপ অনৈতিক। কারণ, শরণার্থীদের সবার একই ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। শুধুমাত্র গায়ের রঙের জন্য কাউকে প্রয়োজনীয় সবকিছু দেয়া হবে, আবার কাউকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া হবে, এটি যে কোন নৈতিকতার পরিপন্থী।
২৬ হাজার ৩৩৮ বর্গকিলোমিটারের রুয়ান্ডা আফ্রিকার চতুর্থ সবচেয়ে ছোট দেশ৷ জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার হিসেবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে রুয়ান্ডায় এক লাখ ১৬৩ জন শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থী ছিলেন৷
গতবছর তালিবান আফগানিস্তান দখল করার পর পালিয়ে যাওয়া আফগানদেরও সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়েছিল রুয়ান্ডা৷
সমালোচকরা বলছেন, ব্রিটেনের সঙ্গে চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামে তার দেশকে পশ্চিমা বিশ্বের বন্ধু হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন৷
৬৪ বছয় বয়সি পল কাগামের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের অনেক অভিযোগ রয়েছে৷
ব্রিটেনের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে সমালোচনা প্রসঙ্গে কাগামে বলেন, এটি ‘মানুষের ব্যবসা’ নয়৷ এটি আশ্রয়প্রার্থীদের নতুন জীবন শুরুর সুযোগ দিবে বলে জানান তিনি৷
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের লুইস মাজ জানান অন্যান্যদের দেশের সঙ্গেও রুয়ান্ডা ব্রিটেনের মতো প্রায় একই রকম চুক্তি করেছে৷ যেমন ইসরায়েল থেকে শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ ডেনমার্কও ব্রিটেনের মতো রুয়ান্ডার সঙ্গে চুক্তি করতে আলোচনা শুরু করেছে৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১১৫৩
আপনার মতামত জানানঃ