সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় কাস্ট আয়রন বা কাঁচা লোহার তৈরি যেকোনো সামগ্রীর রং। লোহার সামগ্রীর ওপরে জমতে থাকে বাদামি রঙের এক বিশেষ পদার্থের প্রলেপ। যাকে মরিচা বলা হয়।
যা মূল্য লোহারই একপ্রকার অক্সাইড। আর্দ্র বাতাসের সঙ্গে লোহার জারণ বিক্রিয়ার তৈরি হয় এই বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ। তবে শুধুই কি ব্যবহারিক সামগ্রী? পৃথিবীর কেন্দ্রও নির্মিত লোহা এবং নিকেল আয়নের সংমিশ্রণে। সেখানেও কি মরিচা পড়তে পারে?
হ্যাঁ, সম্প্রতি এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে আনলেন গবেষকরা। শুধু খোলা হাওয়াতেই নয়, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের ২৯০০ কিলোমিটার নিচে উত্তপ্ত, আয়নিত ও গলিত অবস্থাতেও লোহার মধ্যে মরচের আস্তরণ তৈরি হতে পারে। ল্যাবরেটরিতে তা পরীক্ষার মাধ্যমেই প্রমাণ করলেন গবেষকরা।
পৃথিবী হচ্ছে বিশাল এই মহাবিশ্বের অতি নগণ্য একটি গ্রহ। এটি বর্তুলাকার আকৃতির। আর আমরা এই গ্রহটির বাসিন্দা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে গোলাকার এই পৃথিবীর ওপরে আমরা সবাই বাস করি কিন্তু এর ভিতরে কি আছে? আর আমরা সেখানে কি যেতে পারবো? আসলে পৃথিবী যখন সৃষ্টি হয়েছিল তখন এটি ছিল একটি খুবই উত্তপ্ত গ্যাসের পিন্ড। উত্তপ্ত অবস্থা থেকে এটি ধীরে ধীরে শীতল ও ঘনীভূত হয়।
শীতল হওয়ার সময় ভারী উপাদান গুলো পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে জমা হয় আর হালকা উপাদান সমূহ তাদের ভরের তারতম্য অনুযায়ী নিচের দিক থেকে ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে স্তরে স্তরে জমা হয়। আর এভাবে জমা হয়ে পৃথিবীর ভূভাগ তিনটি মন্ডলে বিভক্ত হয়। এগুলো হলো অশ্বমন্ডল, গুরুমন্ডল, ও কেন্দ্রমন্ডল।
অশ্বমন্ডল এর উপরের অংশকে বলা হয় ভূত্বক যেখানে আমরা আমাদের চার পাশের প্রকৃতি দেখতে পাই। অশ্বমন্ডল এর গভীরতা ৩০ থেকে ৬৪ কি.মি. পর্যন্ত ধরা হয়। অশ্বমন্ডল এর নিচে গুরুমণ্ডল যেখানে সিলিকন, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি ভারী পদার্থগুলো থাকে। এটি কেন্দ্রমন্ডলের উপর থেকে ২৮৯৫ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত।
সবশেষে কেন্দ্র মন্ডল যেটি পৃথিবীর আসল কেন্দ্র। গুরুমন্ডল পর্যন্ত এর ব্যাসার্ধ ৩৪৭৫ কি.মি.। লোহা, সিসা, নিকেল, পারদ ইত্যাদি কঠিন ও ভারী ভারী পদার্থ দিয়ে তৈরি আমাদের পৃথিবীর কেন্দ্র। কিন্তু পৃথিবীর প্রচণ্ড চাপে ওগুলো গলিত অবস্থায় আছে। এমন কোনো বস্তু বা পদার্থ নেই যেটি পৃথিবীর কেন্দ্রে টিকতে পারে।
এই কেন্দ্রে মরিচা ধরা সম্ভব কিনা, সেনা জানতে সরাসরি পানি ও অক্সিজেন ছাড়াও মরিচে তৈরি হতে পারে কিনা, তা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন ফ্লোরিডা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা। ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে ১০ লক্ষ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ তৈরি করে, তারা গলিত লোহার সঙ্গে বিক্রিয়া করান বিভিন্ন অক্সাইড জাতীয় বিভিন্ন খনিজ আকরিকের।
আর তাতেই লোহার ওপর তৈরি হয় মরিচার আস্তরণ। তবে আমরা সাধারণত যে মরিচাকে চিনি, তার থেকে খানিকটা আলাদা এই বিশেষ মরচের রাসায়নিক গঠন। সরাসরি পানি ও অক্সিজেন না পাওয়ায়, অক্সাইড-হাইড্রোক্সাইড গোত্রের উপাদান তৈরি হয় এই বিক্রিয়ায়।
উল্লেখ্য, পৃথিবীর অভ্যন্তরেও এই একই পরিস্থিতি তৈরি হয় ভূপৃষ্ঠের চাপে। ফলে, সেখানেও লোহার ওপর মরিচা তৈরির ঘটনা ঘটছে বলেই দাবি গবেষকদের।
গবেষকদের এই অনুমান সঠিক হলে, তা নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক। কারণ, পৃথিবীর কেন্দ্রে থাকা গলিত ও আয়নিত লোহা ও নিকেলই প্রাণ পৃথিবীর। এই আয়নিত কণার ঘূর্ণনের কারণে তৈরি হয় পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র।
ক্রমাগত মরচে তৈরির ফলে, পৃথিবীর কেন্দ্রক বা কোর কঠিনে পরিণত হলে চৌম্বকক্ষেত্র হারাতে পারে পৃথিবী। তাতে যেমন টেকটোনিক পাতের গতি বন্ধ হয়ে যাবে, তেমনই চৌম্বকক্ষেত্রও হারাতে পারে পৃথিবী। পরিণতি হতে পারে মঙ্গলগ্রহের মতো।
যদিও এই সবটাই অনুমান। পৃথিবীর কেন্দ্রে আদৌ এই বিক্রিয়া চলছে কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা বেশ কঠিন। আর যদি এমনটা হয়েও থাকে, তবে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র নষ্ট হতে সময় লাগবে কয়েক লক্ষ বছর। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা জলবায়ু পরিবর্তনকে হারিয়ে আদৌ ততদিন মানব সভ্যতা টিকে থাকবে কিনা, সেটাই মূলত চিন্তার।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১৫
আপনার মতামত জানানঃ