চলতি বছরের রমজান মাস থেকে ইসরায়েল–অধিকৃত ফিলিস্তিনের মাটিতে বড় ধরনের উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। ইসরায়েলের অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে পবিত্র আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে দেশটির পুলিশ ও ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।
মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসন আরও বেড়েছে আল-আকসা মসজিদকে কেন্দ্র করে। গত কয়েক সপ্তাহে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে সহিংসতায় অন্তত তিনশ জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন।
এদিকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে দুই দিনে চারজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। স্থানীয় সময় গত বুধবার থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এসব প্রাণহানি হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে এক কিশোর, নারী সাংবাদিকও আছেন। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বরাতে এসব তথ্য জানিয়েছে আল–জাজিরা।
ফিলিস্তিনের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির তথ্য অনুসারে, রামাল্লা শহরের কাছে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ১৭ বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। সংস্থাটির বরাতে ফিলিস্তিনের সংবাদমাধ্যম মান নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহত কিশোরের নাম ওদে মোহাম্মদ ওদে। বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রামাল্লার প্যালেস্টাইন মেডিকেল কমপ্লেক্স হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সে। রামাল্লার পশ্চিমাঞ্চলীয় গ্রাম আল মিদিয়ায় তাকে গুলি করেছিল ইসরায়েলি বাহিনী।
গতকাল রেড ক্রিসেন্ট বলেছে, ‘চিকিৎসকেরা তার জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন, তবে শরীরে অত্যন্ত গুরুতর আঘাত থাকার কারণে সে মারা গেছে।’
গত বুধবার সকালে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন ৩১ বছর বয়সী নারী সাংবাদিক গুফরান ওয়ারাসনেহ। অধিকৃত পশ্চিম তীরের হেবরনে অবস্থিত আরুব শরণার্থীশিবিরের প্রবেশমুখে তাকে গুলি করা হয়। এটি ছিল একটি রেডিও স্টেশনে তার নতুন চাকরির তৃতীয় দিন।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটসহ দেশটির সিনিয়র রাজনীতিকরা ফিলিস্তিনি হত্যায় মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহারে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তেমন হুমকি নয় এমন ফিলিস্তিনিদেরও হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, তার কাছে একটি ছুরি ছিল এবং এটি দিয়ে তিনি সেনাদের আঘাতের চেষ্টা করেছিলেন। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা আল–জাজিরাকে বলেছেন, ওয়ারাসনেহ খুব সামান্যই হুমকি তৈরি করেছিলেন।
গত দুই দিনে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত চতুর্থ ফিলিস্তিনি ওদে।গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরের আলো ফোটার আগে বেথলেহেম শহরের ধেইশে শরণার্থীশিবিরে অভিযান চালায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ওই অভিযানে ২৯ বছর বয়সী আয়মান মাহমুদ মোহাইসেন নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার ভোরে বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পশ্চিম তীরের জেনিন শহর। উড়িয়ে দেয়া হয় ফিলিস্তিনি এক নাগরিকের বাড়িঘর। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, গত মার্চে পাঁচ ইসরাইলী নাগরিককে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির বাড়ি ধ্বংস করেছেন তারা।
এর আগে বুধবার রাতে শহরটিতে ইসরায়েলি বাহিনী অতর্কিত অভিযান শুরু করলে, তা প্রতিহত করতে নেমে আসেন সাধারণ ফিলিস্তিনিরা। এসময় তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় ইসরাইলি বাহিনী। নিহত হন বেলাল কাবহা নামের এক যুবক। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন।
গত ২৯ মার্চ তেল আবিবের কাছে বিনেই ব্রাক শহরে বন্দুক হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন দিয়া হামারশেহর বাড়ি গুঁড়িয়ে দিতে বুধবার সন্ধ্যায় অভিযান চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। ওই হামলার ঘটনায় পাঁচজন নিহত হয়েছিলেন। ইসরায়েলি পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে হামারশেহও ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটসহ দেশটির সিনিয়র রাজনীতিকরা ফিলিস্তিনি হত্যায় মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহারে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তেমন হুমকি নয় এমন ফিলিস্তিনিদেরও হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।
ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে তার এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের নিন্দার পাশাপাশি শোক প্রকাশ করেছে ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি কারাবন্দিদের সংগঠন প্যালেস্টিনিয়ান প্রিজোনারস সোসাইটি (পিপিএস)। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো ওয়ারাসনেহ হত্যার পাশাপাশি ইসরায়েলের ‘গুলি করে হত্যার নীতি’র নিন্দা জানিয়েছে।
ইসরায়েলের এসব কর্মকাণ্ডে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। সংস্থাটির মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকর্তারা বলছেন, সামান্যতম সন্দেহ হলেই কিংবা পূর্বসতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে প্রায়ই মারণাস্ত্র ব্যবহার করছে ইসরায়েলি বাহিনী।
চলতি বছরের শুরু থেকেই ইসরায়েল ও অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, পহেলা জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ৫১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের হামলায় ইসরায়েলের ১৯ জন নিহত হয়েছেন।
গত মাসেই (১১ মে) অধিকৃত পশ্চিত তীরের জেনিন শহরে সামরিক অভিযানের সংবাদ সংগ্রহকালে আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাসজুড়ে অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ফিলিস্তিনি মুসলিমদের ওপর একের পর এক হামলা চালানো হয়েছে। এতে অসংখ্য ফিলিস্তিনি আহত হন।
প্রতিদিন গড়ে অন্তত দু’জন ফিলিস্তিনি শিশুকে ধরে নিয়ে যায় ইসরায়েলি সৈন্যরা৷ জেলে পুরে চালায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন৷ প্রায় ৭ হাজার শিশুর ওপর এমন অমানবিক নির্যাতনের তথ্য জানিয়েছিল জাতিসংঘ৷
সারা বিশ্বে শিশুরা যেখানে গড়ে ৬ দশমিক ৮ থেকে ১২ দশমিক ২ শতাংশ পিটিএসডিতে (পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডার) ভুগছে, সেখানে ফিলিস্তিনি শিশুদের মধ্যে এ হার ৩৪ দশমিক ১ থেকে ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ।
বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে ইসরায়েলি সেনাদের আগ্রাসনের ঘটনা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা ও ভীতির বোধ জন্ম নিচ্ছে। ঘর যেখানে তাদের নিশ্চয়তা আর আনন্দের উৎস হওয়ার কথা, তার বদলে ভীতি তাদের তাড়া করে ফিরছে। এর ফলাফল হচ্ছে, শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহ হারাচ্ছে, তারা চুপচাপ, বিষণ্ন কিংবা খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে।
এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালে প্রতি সপ্তাহে ইসরায়েল একজনের বেশি শিশুকে হত্যা করেছে। এর আগের এক দুঃখজনক সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছিল, ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ১৪ বছর গড়ে প্রতি তিন দিনে একটি ফিলিস্তিনি শিশুকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে অধিকৃত পশ্চিম তীরের ৭৯ শতাংশ স্থাপনা নিজেদের দখলে নিয়েছে ইসরায়েল। পূর্ব জেরুজালেমের ২০ শতাংশ স্থাপনা তাদের কবজায়। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয়বিষয়ক কার্যালয়ের (ওসিএইচএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ফিলিস্তিনি মালিকানাধীন অন্তত ৮ হাজার ৪১৩টি স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। এতে সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসেছেন প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ফিলিস্তিনি। বিপরীতে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে এ পর্যন্ত সাড়ে সাত লাখ ইহুদিকে বসতি গড়ে দিয়েছে ইসরায়েল সরকার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হলোকাস্টের নির্মমতাও যেন ছাপিয়ে গেছে ইসরায়েলের বর্বর কর্মকাণ্ডে; নাৎসিদের থেকেও অধিক জিঘাংসু হয়ে উঠেছে জায়নবাদীরা। তাদের একপেশে নির্বিচার হামলা, সর্বাত্মক অবরোধ–আগ্রাসনে অকাল আর অপঘাত মৃত্যু যেন ফিলিস্তিনিদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে যে ‘নাকবা’ নেমে এসেছে ফিলিস্তিনি ভূমিতে, তার তাণ্ডবশক্তির নিচে মানবিকতার পদদলন আর কত দিন? আর কত দিনই বা তা ‘চুপচাপ’ চেয়ে চেয়ে দেখবে বাকি বিশ্ব? আর কত রক্তমূল্য পরিশোধে মানবমুক্তির পয়গাম পৌঁছাবে ফিলিস্তিনি ভূমিতে?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৯
আপনার মতামত জানানঃ