মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মারা গেছেন ৩০০ বছরেরও বেশি সময় আগে, কিন্তু তাকে নিয়ে ভারতে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে উত্তপ্ত বিতর্ক চলছে।
আওরঙ্গজেবকে বলা হয় ‘সর্বশেষ কার্যকর মুঘল সম্রাট’, যিনি ভারতকে ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭ এই অর্ধ-শতাব্দী কাল ধরে শাসন করেছেন। তবে ইতিহাসবিদেরা এ শাসক খুব একটা প্রিয় চোখে দেখেননি কখনো। বিবিসির খবর
সাধারণ মানুষের মধ্যে আওরঙ্গজেবের ইমেজ হলো একজন ধর্মীয় গোঁড়া ব্যক্তি হিসেবে, যিনি হিন্দুদের ঘৃণা করতেন আর যিনি নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে এমনকি নিজের বড় ভাই দারা শিকোহ’কে পর্যন্ত রেহাই দেননি।
আর তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি বৃদ্ধ পিতাকে আগ্রার একটি দুর্গে তার জীবনের শেষ সাড়ে সাত বছর বন্দী করে রেখেছিলেন।
আওরঙ্গজেব পিতা শাহজাহানকে গৃহবন্দী করে, ভাইদের সাথে বিরোধ করে, বড় ভাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিল্লির মসনদ দখল করেছিলেন। এছাড়া অন্য মোগল সম্রাটদের তুলনায় শাসক হিসেবেও ইতিহাসবেত্তাদের চোখে আহামরি কিছু ছিলেন না আওরঙ্গজেব।
তার প্রপিতামহ সম্রাট আকবরকে বলা হয় অসাম্প্রদায়িক একজন শাসক। ওদিকে পিতামহ জাহাঙ্গীরের ছিল শিল্পের প্রতি অগাধ অনুরাগ। পিতা শাহজাহান ছিলেন একজন প্রেমিক পুরুষ যিনি তাজমহল তৈরি করে অমর হয়ে গেছেন ইতিহাসের পাতায়।
কিন্তু ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন তাদের চেয়ে আলাদা। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলাম। তাকে প্রায়ই সম্প্রসারণবাদী হিসেবে দেখা হয়। নিজ শাসনামলে কড়া শরিয়া আইন প্রবর্তন করেছিলেন তিনি। এমনকি অমুসলিমদের জন্য বৈষম্যমূলক জিজিয়া করকেও তিনি পুনরায় প্রবর্তন করেছিলেন।
ইতিহাসে আওরঙ্গজেবকে সঙ্গীত ও শিল্পকলা বিষয়ে নাখোশ এবং হিন্দুমন্দির ধ্বংসকারী হিসেবেও বর্ণনা করা হয়। তবে এসব কিছু ৩০০ বছরের অতীত ইতিহাসের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে আওরঙ্গজেব নতুনভাবে ও নজিরবিহীনভাবে ঘৃণার স্বীকার হচ্ছেন।
হিন্দুদের পবিত্র শহর বারাণসীতে জ্ঞানবাপী মসজিদকে কেন্দ্র করে বিতর্কের মধ্য দিয়ে এটা শুরু হয়। বিশ্বনাথ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের নির্দেশে ১৬৬৯ সালে ষোড়শ শতাব্দীর এই হিন্দু মন্দিরটি ধ্বংস করা হয়। এখন সোশাল মিডিয়াতে তাকে নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে আওরঙ্গজেবের জন্য মর্যাদাহানিকর হাজার হাজার রেফারেন্স, আদালতের ফাইলেও এসব পাওয়া যাচ্ছে এবং ভারতের বর্তমান হিন্দু জাতীয়তাবাদী শাসকরাও এসব বক্তব্য তুলে ধরছেন।
ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘু যারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিন্দু জনরোষে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তাদেরকে খারাপ হিসেবে তুলে ধরতে আওরঙ্গজেব ‘একটি সুবিধাজনক নামে’ পরিণত হয়েছে।
ডিসেম্বর মাসে বারাণসীতে এক অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘আওরঙ্গজেবের নৃশংসতা এবং সন্ত্রাসের’ বিষয়ে কথা বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন ‘তিনি তরবারির সাহায্যে সভ্যতা বদলানোর চেষ্টা করেছেন। গোঁড়ামির মাধ্যমে তিনি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চেষ্টা করেছেন’।
গত মাসেও শিখ গুরু তেগ বাহাদুরের ৪০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি এই মুঘল সম্রাটের নাম উল্লেখ করেছেন। ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকার করলে তেগ বাহাদুরের শিরশ্ছেদ করা হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ‘যদিও আওরঙ্গজেব অনেক মস্তক বিচ্ছিন্ন করেছেন, তিনি আমাদের বিশ্বাসে নাড়া দিতে পারেননি’। তার এই মন্তব্যে ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন একজন কানাডীয়-আমেরিকান সাংবাদিক যিনি টুইটারে প্রশ্ন তুলেছিলেন ‘ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কেন ৩০০+ বছর আগে মারা যাওয়া একজন মুঘল সম্রাটকে আক্রমণ করে লম্বা বক্তৃতা দিচ্ছেন?’
বেশ কয়েকটি টুইটের মাধ্যমে ঐতিহাসিক অড্রে ট্রাশকি এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা বিশ্বাস করে যে ‘মুসলিমরা শত শত বছর ধরে হিন্দুদের পীড়িত করেছে, এবং একারণে আজকের দিনে অতীতের উচিত শাস্তি হিসেবে তাদেরও পীড়িত হতে হবে’।
তিনি বলেন, ‘বর্তমান কালের মুসলিমদের ঘৃণা করা এবং তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা গ্রহণযোগ্য এই ইঙ্গিত দিতেই আওরঙ্গজেবের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে’।
টুইটারে এই আলোচনার পর আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে আরো অনেক ঘৃণা জমা হয়েছে। আগ্রা শহরের মেয়র তাকে একজন ‘কসাই’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন সব জায়গা থেকে তার চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে।
টুইটারে মুঘল এই সম্রাটকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘একজন দখলদার’ হিসেবে যিনি হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চেয়েছিলেন। একজন টুইটার ব্যবহারকারী এও বলেছেন হিন্দুদের পূজা করার জায়গায় মুঘলরা যেসব স্মৃতিস্তম্ভ এবং ভবন নির্মাণ করেছে সেগুলো বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলতে হবে।
ভারতের একজন আঞ্চলিক রাজনীতিবিদ আওরঙ্গজেবের সমাধির ‘অস্তিত্ব ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তার’ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার পর পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে তার সমাধিস্থল দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওই নেতা আওরঙ্গজেবের সমাধি ধ্বংস করে ফেলারও আহবান জানিয়েছেন।
ইতিহাসবিদ, লেখক এবং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাদিম রেজাভি বলেছেন, ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘু যারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিন্দু জনরোষে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তাদেরকে খারাপ হিসেবে তুলে ধরতে আওরঙ্গজেব ‘একটি সুবিধাজনক নামে’ পরিণত হয়েছে।
অধ্যাপক রেজাভি বলেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বেশ কিছু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন এবং হিন্দুদের ওপর বৈষম্যমূলক কর আরোপ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি ছিলেন জটিল একজন ব্যক্তি এবং তিনি পুরোপুরি শয়তান ছিলেন না। ‘হিন্দু মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সর্বোচ্চ পরিমাণে অনুদান দিয়েছেন, তার রক্তের দিক থেকেও তিনি নিজেও দুই-তৃতীয়াংশ হিন্দু ছিলেন কারণ তার প্রপিতামহ আকবর একজন রাজপুতকে (একটি হিন্দু সম্প্রদায়) বিয়ে করেছিলেন এবং তার শাসনামলে ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের মধ্যে আরো অনেক রাজপুত ছিলেন,’ বলেন তিনি।
অধ্যাপক রেজাভি বলেন আওরঙ্গজেব তার ব্যক্তিগত জীবনে মৌলবাদী ছিলেন না, যদিও এই ধারণাটি জনপ্রিয়, এবং ‘তিনি মদ্যপান উপভোগ করতেন, বীণা বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন এবং অন্য যে কোন মুঘল শাসকের সময়ের তুলনায় তার অধীনেই সঙ্গীতের ওপর অনেক বেশি বই রচিত হয়েছে’।
তবে তিনি বলেন ‘রাজনৈতিক ব্যর্থতা ধামাচাপা দিতে এবং কর্তৃত্ব জোরালো করতে আওরঙ্গজেব ধর্মের আশ্রয় নিয়েছেন—যা অনেকটাই বর্তমান সময়ের ভারতীয় নেতাদের মতো।
‘তবে প্রশ্ন হচ্ছে আওরঙ্গজেব যদি খারাপ ও দুষ্ট প্রকৃতির হন, একজন সাম্প্রদায়িক এবং মৌলবাদী, যিনি মন্দির ধ্বংস করেছেন, আজকের দিনে কি আমাদেরকে তাকেও ছাড়িয়ে যেতে হবে?’
‘তিনি একজন স্বৈরশাসক এবং সম্রাট ছিলেন যিনি ৩০০ বছর আগে বেঁচে ছিলেন। সেসময় আধুনিক গণতন্ত্র ছিল না, তাকে পরিচালনার জন্য কোন সংবিধান ছিল না। কিন্তু এখন আমাদের ভারতীয় সংবিধান আছে এবং পার্লামেন্টের আইন আছে, তাহলে যেসব কাজ ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে করা হয়েছে সেগুলো এখন আমরা কিভাবে পুনরাবৃত্তি করতে পারি?’ প্রশ্ন করেন ড. রেজাভি।
‘সুতরাং কেউ যদি সপ্তদশ শতাব্দীর রাজনীতিকে আশকারা দেয়, তাহলে আওরঙ্গজেব সপ্তদশ শতাব্দীতে যেসব অপরাধ করেছিলেন, তারা এর চেয়েও আরো বড় অপরাধ করছে,’ বলেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির গৌরব অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার কলঙ্ক— এ দুইয়ের মধ্যে কোনটিকে ভারতের নেতৃবৃন্দ বেছে নেবেন, তা তাদেরই ঠিক করতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে কখনও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সহাবস্থান হতে পারে না। একটি দেশ শুধু আকার-আয়তনে ও জনসংখ্যার আধিক্যের বিচারেই বড় হয়ে উঠতে পারে না। বড় দেশ বলে পরিচিত হতে হলে মন-মানসিকতার ক্ষেত্রে ও বড় হতে হবে। এজন্য মানবিকতা ও বিশ্বজনীনতার চর্চা বাড়াতে হবে, আকারের বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিয়মিত নির্বাচনের নীতি অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও জাত-পাতের বৈষম্যের কারণে ভারতের এখনও প্রকৃত সভ্য দেশ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার অনেক বাকি, এ নির্মম সত্যটা ভারতীয় নেতৃবৃন্দের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৪
আপনার মতামত জানানঃ