পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে৷ কিন্তু এই সেতুর দিয়ে যশোর থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত ৪০ কোটি টাকার রেল লিংক প্রকল্প বোঝা হয়ে দাঁড়াবে, যার ২১ হাজার কোটি ঋণ চীনের-এমনটাই মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম।
বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বল্প প্রয়োজনীয় প্রকল্প নেয়া থেকে সরকারকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অনেক অর্থনীতিবিদই। আবার অনেকে মনে করেন, দেশের অর্থনীতি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি আসেনি৷
পাশাপাশি আমদানি বেড়ে যাওয়ায় তৈরি হওয়া বাণিজ্যিক ঘাটতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন অধ্যাপক মুইনুল ইসলাম৷ তিনি মনে করেন গত আট মাসে যেভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে সেটি অব্যাহত থাকলে তা বিপদজনক স্তরে যেতে বেশিদিন লাগবে না৷
পদ্মা সেতু
মইনুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে যখন সড়ক যাতায়াত চালু হয়ে যাবে তখন পায়রা, যশোর ও মংলায় মালামাল পরিবহণের ক্ষেত্রে এই রেললাইনের যে তুলনামূলক খরচ সেটা কোনদিন সড়ক যোগাযোগের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক হবে না৷
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে একনেকের বৈঠকে পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। এরপর বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি ইত্যাদি ঘুরে বহুত জল ঘোলা করে প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখে। ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে তা দ্বিগুণ হয়ে গেল অবিশ্বাস্য কারিশমায়! ২০১৬ সালে খরচ বাড়িয়ে ধরা হয় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে আরো ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে বর্তমান ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।
তবে এর সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। কারণ নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় পুরোটা সেতু কর্তৃপক্ষকে ঋণ হিসেবে দিচ্ছে অর্থ বিভাগ। এক শতাংশ সুদসহ ৩৫ বছরে এ অর্থ ফেরত দেবে সেতু বিভাগ। ফলে ২০৫৭ সাল পর্যন্ত বিবিএকে টানতে হবে ঋণের বোঝা। আর এ ঋণ শোধের জন্য সেতুটির টোলের হারও ধরা হয়েছে বেশি।
এদিকে পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে ঋণ দিয়েছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। দুই শতাংশ সুদে ৩০ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে বিবিএকে। এ ঋণের বোঝা টানতে হবে ২০৩৭ সাল পর্যন্ত।
সম্প্রতি পদ্মা সেতুর ঋণ, সুদহার, কিস্তির সংখ্যা ইত্যাদি বিষয় পর্যালোচনায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর সেতু ভবনে। এতে জানানো হয়, চুক্তি অনুযায়ী পদ্মা সেতুর ঋণের কিস্তি চলতি অর্থবছর থেকে পরিশোধ শুরু করার কথা ছিল। তবে কভিডের কারণে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়া এক বছর বিলম্বিত হয়। তাই পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে অর্থ বিভাগের ঋণ পরিশোধ শুরুর সময়সীমাও এক বছর পেছানো হয়। আগামী জুনে সেতুটি উদ্বোধন করা হবে। আর আগামী (২০২২-২৩) অর্থবছর থেকে সেতুটির ঋণ শোধ শুরু করা হবে। ২০৫৬-৫৭ অর্থবছর পর্যন্ত এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এ ঋণ পরিশোধে ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট চুক্তি সই করে সেতু কর্তৃপক্ষ ও অর্থ বিভাগ।
ঋণচুক্তি অনুযায়ী, আগামী অর্থবছর থেকে ৩৫ বছরে অর্থ বিভাগের ঋণ পরিশোধ করা হবে। আর সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে প্রায় ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। ঋণ পরিশোধের শিডিউল অনুযায়ী প্রতি অর্থবছরে প্রায় সর্বনিম্ন ৮২৬ কোটি থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হবে। ত্রৈমাসিক হিসেবে প্রতি বছর চারটি ও ৩৫ বছরে মোট ১৪০টি কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করা হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতি কিস্তি-পরবর্তী ঋণ স্থিতির ওপর সুদ হিসাব করা হয়েছে। এ ছাড়া সেতু কর্তৃপক্ষ চাইলে সুদসহ অর্থ অগ্রিমও পরিশোধ করতে পারবে। তবে কোনো কারণে একটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে, তা পরবর্তী কিস্তির সঙ্গে বকেয়াসহ পরিশোধ করতে হবে।
এদিকে, গত ১৭ মে জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী দেখা যায়, যাত্রীবাহী পরিবহনের ক্ষেত্রে ফেরির তুলনায় সেতুতে টোল কিছুটা বেশি। মোটরসাইকেলসহ ব্যক্তিগত যানবাহনের টোলও ফেরির তুলনায় সামান্য বেড়েছে। তবে পণ্যবাহী যানের ক্ষেত্রে টোল অনেক বেশি ধরা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর টোল হার মোটর সাইকেল ১০০ টাকা, কার ও জিপ ৭৫০ টাকা, পিকআপ এক হাজার ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস এক হাজার ৩০০ টাকা, ছোট বাস (৩১ আসন বা এর কম) এক হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাস (৩২ আসনের বেশি) দুই হাজার টাকা এবং বড় বাস (তিন এক্সেল) দুই হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ছোট ট্রাক (পাঁচ টন পর্যন্ত) এক হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (পাঁচ থেকে আট টন পর্যন্ত) দুই হাজার ১০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (আট থেকে ১১ টন) দুই হাজার ৮০০ টাকা, ট্রাক (তিন এক্সেল পর্যন্ত) পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা, ট্রেইলার (চার এক্সেল পর্যন্ত) ছয় হাজার টাকা ধরা হয়েছে। আর চার এক্সেলের বেশি ট্রেইলারের ক্ষেত্রে প্রতি এক্সেলে দেড় হাজার টাকা যোগ হবে।
এদিকে, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পদ্মা সেতুর যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে, তা এই পথের শেষ টোল নয়। পদ্মা সেতুর সঙ্গে মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের টোলও দিতে হবে। এতে এই পথে যাতায়াতকারীদের সড়ক ও সেতুর দুটি টোল দিতে হবে। তাই পদ্মা সেতু ও ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের টোল সাধারণ মানুষের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছে কি না তা দেখা উচিত।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প
অন্যদিকে রাশিয়ার বারশো কোটি টাকার ঋণে মোট এক লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পও বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা হয়ে থাকবে বলে উল্লেখ করেন তিনি৷
দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ। বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল অংশ রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল বা পরমাণু চুল্লিপাত্র বসেছে গত অক্টোবরেই। আগামী বছর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ও ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। প্রকল্পটির প্রায় পাঁচ হাজার বিদেশী কর্মী এখন ঈশ্বরদীর রূপপুরে অবস্থান করছেন, যাদের বেশির ভাগই রুশ নাগরিক।
এর মধ্যেই ইউক্রেনে শুরু হওয়া যুদ্ধ প্রকল্পটি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। রাশিয়ার ওপর একের পর এক বিধিনিষেধ দিয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাত্ক্ষণিকভাবে প্রকল্পটির ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব দেখা না গেলেও দীর্ঘমেয়াদে বেশকিছু বিড়ম্বনা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে রাশিয়ার আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশটি নিজ থেকেই প্রকল্পের কাজের গতিতে লাগাম টানতে পারে। আবার বিধিনিষেধের কারণে আর্থিক লেনদেনেও দেখা দিতে পারে বিপত্তি। সেক্ষেত্রে প্রকল্পের বাংলাদেশী কর্মীদের বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে প্রকল্পের নির্মাণ উপকরণ সরবরাহকারী স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ পরিশোধ নিয়েও বিড়ম্বনার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ শেষে জ্বালানি, পারমাণবিক বর্জ্য, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়েই যুক্ত থাকতে হবে রুশ কর্মীদের। সে বিষয়টিকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে চলমান যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা।
বিষয়টি নিয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমানে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এক্ষেত্রে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পরও আরো অনেক কাজ রয়েছে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ না থাকলেও দীর্ঘমেয়াদের প্রভাব নিয়ে আশঙ্কা রয়ে গিয়েছে।
তিনি বলেন, বিষয়টি এমন নয় যে অবকাঠামো নির্মাণ মানেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শেষ। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর নিউক্লিয়ার প্লান্টের কমিশনিং শুরু হবে। যথাযথভাবে কমিশনিংয়ের (সচল হওয়া) জন্য সেফটি, সিকিউরিটি ও সেফগার্ডস—তিনটি ধাপ রয়েছে। মূল কমিশনিং হবে যখন জ্বালানি লোডিংয়ের পর রিঅ্যাকশন শুরু হবে। মূল জ্বালানি লোডিংয়ের সঙ্গেও অনেকগুলো অবকাঠামো জড়িত রয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ব্যবস্থা হলো নিউক্লিয়ার গভর্ন্যান্স। বিষয়টি শুধু দেশের আইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এর জন্য আন্তর্জাতিক আইন, চুক্তি ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির বিষয়ও জড়িত রয়েছে। এসব কর্মযজ্ঞ শেষ হতে এখনো দেরি আছে। এর মধ্যে বর্তমান যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে কী হবে তা সময় গেলেই বোঝা সম্ভব হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৪৫
আপনার মতামত জানানঃ