সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তার বিচারে শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে অনেকগুণ এগিয়ে আছেন ইউনূস। এটাও কি তার শেখ হাসিনার রোষে পড়ার অন্যতম কারণ নয়? কানাডা প্রবাসী এক বাংলাদেশী একবার বলছিলেন, ৯০ ভাগ কানাডিয়ান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নামও জানেন না, কিন্তু ড. ইউনূসের নাম তারা জানেন।
২০০৬ সালে নোবেল জয়ের পর থেকেই শেখ হাসিনা কেন যেন রুষ্ট হয়ে পড়েন ড. ইউনূসের ওপর। কথামালায় তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল, তবে অতোটা নয়। ওয়ান-ইলেভেনের পর ক্ষমতায় এসে হাসিনার মুখের ভাষা একটু একটু করে বিষ ছড়াতে থাকে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ইউনূস একটি দল গঠনের চেষ্টা করেছিলেন, সেটা হয়তো একটি কারণ, তবে মূল কারণ নয়।
নরওয়ে টেলিভিশনে গ্রামীণ ব্যাংকের তহবিল স্থানান্তর-সংক্রান্ত একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রচার হওয়ার পর হাসিনা ভদ্রতার মুখোশটা ফেলে স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হলেন। প্রধানমন্ত্রীই শুধু নন, তার অমাত্যবর্গও অশোভন বাক্যবাণে বিদ্ধ করে চলছিলেন ইউনূসকে। এমনকি চাঁদাবাজ ছাত্রলীগও একপর্যায়ে মামার বাড়ির আবদার জানিয়ে বসল যে, ইউনূসের নোবেল পদক কেড়ে নিতে হবে।
মাহবুবুল আলম হানিফ, আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল মুখপাত্র ইউনূসের নামে প্রকাশ-অযোগ্য সব বক্তব্য দিতে লাগলেন। একসময় দেখা গেল, ইউনূসের পক্ষে নরওয়ে সরকারের আনুষ্ঠানিক বিবৃতির পরও সরকার ইউনূসের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করে ফেলল। সেটা চলতে চলতেই ইউনূসকে জড়ানো হল একের পর এক হাস্যকর মামলায়, তাও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
এরপর ইউনূসকে সরিয়ে দেওয়া হল তার নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক থেকে। সরকার আইনের দোহাই দিয়ে ইউনূসকে সরিয়েছে, ইউনূসও সেই আইনের কাছেই তার বিচার চাইতে গিয়েছিলেন। টানা তিন দিন আদালতের অস্বাভাবিক আচরণ দেখে ইউনূসের আইনজীবীরা স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন, ন্যায়বিচার তারা পাবেন না।
আবার শেখ হাসিনার ইউনূস তিক্ততা সামনে এসেছে নতুন করেন। ইউনূসকে চুবান আর খালেদাকে ডুবান- শেখ হাসিনা একথা বলেছেন৷ আসুন এই কথার আড়ালে শেখ হাসিনার মাস্তানিটা ব্যাখ্যা করা যাক। তার আগে জেনে নেওয়া যাক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূলত কী বলেছেন।
যা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, একটি এমডি পদের জন্য পদ্মাসেতুর মতো সেতুর টাকা বন্ধ করেছে, তাকে পদ্মা নদীতে দুইটা চুবানি দিয়ে তোলা উচিত। মরে যাতে না যায়, পদ্মা নদীতে একটু চুবানি দিয়ে সেতুতে তুলে দেয়া উচিত। তাহলে যদি শিক্ষা হয়। পদ্মা সেতুর অর্থ বন্ধ করালো ড. ইউনূস। কেন? গ্রামীণ ব্যাংকের একটি এমডি পদে তাকে থাকতে হবে।
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষ্যে বুধবার (১৮ মে) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চলে আলোচনা সভা ও ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি। তাতে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, তাকে (ড. ইউনূস) আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, গ্রামীণ ব্যাংকের উপদেষ্টা হতে। উপদেষ্টা হিসেবে থাকা আরও উচ্চমানের। তার এমডি-ই থাকতে হবে। সেটা সে ছাড়বে না। কিন্তু তার বয়সে কুলায় না।
ড. ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোর্ট আর যাই পারুক, তার বয়স তো ১০ বছর কমিয়ে দিতে পারবে না। কারণ গ্রামীণ ব্যাংকের আইনে আছে, ৬০ বছর পর্যন্ত এমডি পদে থাকতে পারবে। তখন তার বয়স ৭১ বছর। বয়সটা কমাবে কীভাবে? সে মামলায় হেরে যায়। কিন্তু প্রতিহিংসা নেয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা শুনেছি, সে আর মাহফুজ আনাম আমেরিকায় যায়। স্টেট ডিপার্টমেন্টে যায়। হিলারি ক্লিনটনকে ইমেইল করে। মি. জোয়েলিক সে সময় বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার শেষ কর্ম দিবসে, কোনো বোর্ড সভায় নয়, পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করে দেয়।
তাতে একদিকে সাপেবর হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ যে নিজের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করতে পারে, সেটা আজকে আমরা প্রমাণ করেছি। কিন্তু আমাদের এখানে একজন জ্ঞানী লোক বলে ফেললেন, পদ্মাসেতুতে যে রেল লাইন হচ্ছে, তাতে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, তা তো ঋণ নিয়ে করা হচ্ছে। এ ঋণ কীভাবে শোধ হবে? দক্ষিণবঙ্গের কোনো মানুষ তো রেলে চড়বে না। তারা তো লঞ্চে যাতায়াত করে। তারা রেলে চড়তে যাবে কেন? এই রেল ভায়াবল হবে না।
সরকার প্রধান বলেন, সেতুর কাজ হয়ে গেছে। সেতু নিয়ে কথা বলে এখন পারছে না। রেলের কাজ হচ্ছে, এখন রেল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা। যাক, আমার মনে হয়, উনাকে সকলেরই চিনে রাখা উচিত। রেলগাড়ি যখন চালু হবে, উনাকে রেলে চড়ানো উচিত।
আর খালেদা জিয়া বলেছিল, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে। সেতুতে যে স্প্যানগুলো বসাচ্ছে, এগুলো তার কাছে ছিল জোড়াতালি দেয়া। বলেছিল, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মাসেতু বানাচ্ছে, ওখানে চড়া যাবে না। চড়লে ভেঙে পড়বে। আবার তার সাথে কিছু দোসররাও… তাদেরকে এখন কী করা উচিত? পদ্মা সেতুতে নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে টুস করে নদীতে ফেলে দেয়া উচিত।
শেখ হাসিনা বলেন, আর যিনি আমাদের একটা এমডি পদের জন্য পদ্মা সেতুর মতো সেতুর টাকা বন্ধ করেছে তাকেও আবার পদ্মা নদীতে নিয়ে দুইটা চুবানি দিয়ে উঠাইয়া নেয়া উচিত। মরে যাতে না যায়। তাহলে যদি এদের শিক্ষা হয়। বড় বড় অর্থনীতিবিদ, জ্ঞানী-গুণী এই ধরনের অবার্চীনের মতো কথা বলে কীভাবে? সেটাই আমার প্রশ্ন। মেগা প্রজেক্টগুলো করে নাকি খুব ভুল করছি। তারা আয়েশে বসে থাকে আর আমার তৈরি করা সব টেলিভিশনে গিয়ে কথা বলে। বিদ্যুৎ সরবরাহ করি। সেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আজকে যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছি সেটা নিয়েও সমালোচনা, এত টাকা দিয়ে স্যাটেলাইট করে কী হবে? এই প্রশ্নও কিন্তু তুলেছে তারা। অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছু করলে তাদের গায়ে লাগে। কেন? তাহলে তারা কি এখনও সেই পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের পদলেহনকারী, খোশামদী, তোষামদির দল? গালি-টালি দেই না, দেয়ার রুচিও নাই। তবে একটু না বলে পারি না যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেভাবে বাংলাদেশের মেয়েদের ওপর অত্যাচার করেছে, গণহত্যা চালিয়েছে, অগ্নিসংযোগ করেছে, পোড়ামাটি নীতি নিয়ে বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সেই পাকিস্তানিদের পদলেহনকারী দল বাংলাদেশে এখনও জীবিত। এটাই হচ্ছে দুঃখজনক। এরা এখনও বাংলাদেশের ভালো কিছু হলে দেখে না। বাংলাদেশ এগিয়ে গেলে তাদের ভালো লাগে না।
শেখ হাসিনার মাস্তানি
ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউনূসকে চুবানি দিয়ে শেখ হাসিনা তুলে আনতে বলেছেন৷ স্পেসিফিক করে বলেছেন, মরে যাতে না যায়, নদীতে চুবানি দিয়ে সেতুতে তুলে দেওয়া উচিত৷ খালেদা প্রসঙ্গে কিন্তু তিনি তা বলেননি, বলেছেন ওখানে নিয়ে গিয়ে তাকে টুস করে ফেলে দিতে৷ তুলে আনতে আর বলেননি৷ পাঠক, আপনার কী মনে হয়? হাসিনা না বুঝে এই দুটো বিষয়ের মধ্যে ফারাক রেখেছেন?
আমার তা মনে হয় না৷ আমার মনে হয় ইউনূস এবং অন্য বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এরকমই ভাবেন তিনি, চুবাবেন আবার তুলেও আনবেন৷ কারণ তারা তার প্রতিপক্ষ নন৷ অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে টুপ করে সেতুর নিচের পানিতে ফেলে দেবেন৷ অল্প কথায় জীবন দর্শনের অসাধারণ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী৷
এখন অনেকেই আছেন, যারা শেখ হাসিনার কথাকে পালনীয় বাণী মনে করেন! তাদের কেউ যদি শেখ হাসিনার এই কথাকে বাস্তব রূপ দিতে চান তবে কী হবে? সরকার কি তাদের সাহায্য করবে? কে জানে আগামীকালই হয়ত আওয়ামী লীগে ইউনূস চুবানি কমিটি বা খালেদা ডুবানি কমিটি গঠিত হবে৷ পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি নিশ্চয়ই ভাবগম্ভীর পরিবেশে উদ্বোধনী বক্তব্য নিয়ে ভাবছেন৷ অনেকগুলো মিডিয়া থাকে ইদানীং, তাই কোন ঘড়ির সাথে কোন মাফলার পরবেন, এত গুরুত্বপূর্ণ কথার সঙ্গে কোন রবীন্দ্র সংগীত ভাল যায় তাও নিশ্চয়ই ভেবে রাখছেন৷
সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই সাবাশি দিচ্ছেন৷ পদ্মা সেতু করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বাহবা পুরান হয়ে গেছে, এখন সাবাশ আসছে ডুবানি আর চুবানির জন্য৷ ভাল করেছেন, ভাল বলেছেন৷
অথচ শেখ হাসিনা তার অভিযোগের স্বপক্ষে কোন প্রমাণাদি সামনে আনতে পারেননি। যদিও ভিত্তিহীনভাবে ড. ইউনূসের মতো একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে অপমান করে চলেছেন, নিজস্ব বিরোধের জায়গা থেকে। এটা কি প্রধানমন্ত্রী পদের অপব্যবহার নয়?
‘তাকে পদ্মা নদীতে দুইটা চুবানি দিয়ে তোলা উচিত। মরে যাতে না যায়, পদ্মা নদীতে একটু চুবানি দিয়ে সেতুতে তুলে দেয়া উচিত।’- এটা কি সরাসরি হুমকি নয়? একজন প্রধানমন্ত্রী হয়ে গণমাধ্যমে তার এই অবস্থান, ইতিমধ্যেই ক্ষমতার অপব্যবহারে সকল সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের তৃণমূল স্থানীয় নেতাদের এবং ছাত্রলীগকে কি প্রশ্রয় দেওয়া নয়? আর বিএনপিত যদি নির্বাচন নিয়ে কথা বলার অধিকার না থাকে, তাহলে অধিকার কি ‘রাতের ভোট’ খ্যাত আওয়ামী লীগের আছে শুধু?
ড. ইউনূস ও শেখ হাসিনার সমস্যার সূত্রপাত
২০১০ সালের নভেম্বরে নরওয়ের জাতীয় টেলিভিশনে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র সম্প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ সরকার ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগে। প্রামাণ্য চিত্রে দাবি করা হয়েছিল, ১৫ বছর আগে গ্রামীণ ব্যাংকের লাখ লাখ ডলার হাওয়া হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সতর্কতার সঙ্গে রাজনৈতিক ডামাডোল পিটিয়ে ড. ইউনূসকে হেনস্থা করার প্রেক্ষাপট নির্মাণ করেন।
এ সংক্রান্ত ইকনমিস্টের রিপোর্টে বলা হয়, শেখ হাসিনা যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন, তখন ড. ইউনূসের ব্যাপারে তিনি অতটা কঠোর ছিলেন না। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানদের ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষ সম্মেলনের কো-চেয়ারম্যান হিসেবে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমরা বাংলাদেশে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার গড়া গ্রামীণ ব্যাংকের অসাধারণ কার্যক্রমে গর্বিত।”
সুতরাং যে কেউ এটা আশা করতে পারেন, এই শীর্ষ সম্মেলনের ৯ বছর (২০০৬-এ) পর যখন ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পেলেন, তখন শেখ হাসিনাও তার ওপর সন্তুষ্ট থাকবেন। কিন্তু আসলে তা হয়নি। ইকনমিস্টের ভাষায়, নোবেল প্রাপ্তির মাধ্যমে ড. ইউনূস হঠাৎ করেই প্রধানমন্ত্রীর বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়েও বিখ্যাত হয়ে যান। যারা শেখ হাসিনাকে খুব কাছ থেকে জানেন, তাদের মতে, এটা মেনে নেয়া শেখ হাসিনার পক্ষে তেতো ওষুধ গেলার চেয়েও কঠিন হয়ে দাড়ায়।
ওই ম্যাগাজিনে বলা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানসিক অসন্তুষ্টি সরাসরি ব্যক্তিগত বিরোধে রূপ নেয়, নোবেল পাওয়ার পাঁচ মাস পর ড. ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন। সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের শাসন আমলে ড. ইউনূস এ ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেনানায়করা আশা করেছিলেন, দেশটির রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়াকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব। কিন্তু তারা মাইনাস-টু- ফর্মুলা বাংলাদেশী জনগণকে গেলাতে পারেননি। ড. ইউনূস রাজনৈতিক অঙ্গনে বিদ্যমান দুর্নীতির জঞ্জাল সরাতে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা চিরতরে উচ্ছেদ করার পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী ছিলেন।
ইকনমিস্টে লেখা হয়েছে, ড. ইউনূসের অভিপ্রায় যা-ই হোক না, রাজনীতিতে তার নাক গলানোর এই উদ্যোগকে শেখ হাসিনা নিজের ও তার দলের জন্য হুমকি হিসেবে দেখেছেন। ইকনমিস্টের মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ একজন সিনিয়র আমলা বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) মনে করলেন ড. ইউনূস (তার মতে) সেনাবাহিনীর তৎপরতার সঙ্গে জড়িত এবং তাকে রাজনীতি থেকে অপসারণের চেষ্টা করছেন। এ কারণে সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা ড. ইউনূসের পরিকল্পনাও বটে।
এর মধ্যে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দাবি করে, ১৯৯৯ সাল থেকে ড. ইউনূস অবৈধভাবে গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা এমডি’র পদ দখল করে আছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তি হচ্ছে গ্রামীণ বাংক পরিচালনা পরিষদ ড. ইউনূসের পুনর্নিয়োগ অনুমোদন করেনি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম জহিরের উদ্ধৃতি দিয়ে ইকনমিস্ট বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক খুব ভালো করেই জানতো ড. ইউনূস সঠিকভাবেই গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে আছেন। তার ভাষায়, বাংলাদেশ ব্যাংক যখন এতদিন ধরেই তাকে ওই পদে থাকতে দিয়েছে, তাতে ইউনূসের পদে থাকার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে সম্মতি ছিল, তা আমরা ধরেই নিতে পারি।
ইকনমিস্টের আশঙ্কা, সরকারের প্রসঙ্গ এলেই বাংলাদেশের আদালতগুলো ক্রমান্বয়ে সরকারের মুখপানে চেয়ে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই ড. ইউনূসকে তার পদে ফিরিয়ে দেয়ার রায় দিতে হলে খুবই সাহসী কোনো বিচারপতির প্রয়োজন রয়েছে। ইকনমিস্ট আরও লিখেছে, সম্ভবত পুরো ঘটনার সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংকের পদ থেকে ড. ইউনূসকে সরাতে বাংলাদেশ সরকার তার আন্তর্জাতিক সুনামকে কতোটা ঝুঁকিতে ফেলতে আগ্রহী হবে। এবং আমরা সবাই জানি, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সুনামকে কতটা ঝুঁকিতে ফেলেছিল।
ওই সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন। ড. ইউনূসের ব্যাপারে কথা বলেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। তবে হিলারী পাত্তা পাননি। শেখ হাসিনা নিজের পথেই হেটেছেন। একা হিলারীই নন বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রীই ড. ইউনূসের পক্ষে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তারা সরাসরিই ড. ইউনূসের বিষয়টির সম্মানজনক সুরাহা চেয়েছেন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে অসৌজন্যমূলকভাবে। হাইকোর্টে সরকারের অবস্থানকে বৈধতা দিয়েছে।
এরপর ২০১৮ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কারণে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করেছিল বিশ্বব্যাংক বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়মানুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকসহ পশ্চিমা বিশ্বের কিছু নেতা পদ্মা সেতু নির্মাণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এমডি পদ হারিয়ে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস পদ্মা সেতুর অর্থায়ন আটকানোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন বলে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, হিলারি ক্লিনটন তাকে এমডি রাখতে ফোন করেন। টনি ব্লেয়ার ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। তার স্ত্রী শেরি ব্লেয়ার ফোন করলেন। পশ্চিমা দেশের অনেক রাষ্ট্রদূত এসে আমাকে হুমকি দিতেন। ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরানো হলে পদ্মা সেতু হবে না- ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও এসবের কোন প্রমাণ দেখাতে পারেননি শেখ হাসিনা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ