২০২১ এবং ২০২২ সালে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনসমূহ, নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সংবিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ রেখেই তিনটি নতুন আইন, প্রবিধান ও নীতিমালা প্রস্তাব করেছে৷
প্রস্তাবিত এই আইন, প্রবিধান ও নীতিমালা তিনটি হলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রস্তুতকৃত প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২; বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) প্রস্তুতকৃত প্রস্তাবিত ‘রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফরমস’ এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত ‘ওভার দ্য টপ’ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান ও পরিচালনা নীতিমালা, ২০২১৷
১৮ জানুয়ারি ২০২১, আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদ কর্তৃক হাইকোর্ট বিভাগে আবেদনের প্রেক্ষিতে, বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ওটিটি থেকে অশ্লীলতা রোধ, রাজস্ব আদায় এবং এসব প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণে খসড়া নীতিমালা প্রণয়নের আদেশ দেন৷
সেই প্রেক্ষাপটে, ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) কর্তৃক ইংরেজিতে প্রস্তুতকৃত রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফরমস’ খসড়া ইংরেজিতে প্রস্তুত করে কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে৷
খসড়া এ নীতিমালার ওপর নাগরিকদের পর্যবেক্ষণ, মতামত ও সুপারিশ বিগত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখের মধ্যে প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়৷ দুই সপ্তাহের মধ্যে কতজন নাগরিক এবং নাগরিক সংগঠনসমূহ এই রেগুলেশন সম্পর্কে জেনেছিলেন এবং তাদের পর্যবেক্ষণ, মতামত ও সুপারিশ বিটিআরসি এর নির্দিষ্ট ইমেইলে পাঠিয়েছিলেন তা নাগরিকদের জানা প্রায় অসম্ভব৷
বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ীও রেগুলেশনটির প্রস্তুত প্রক্রিয়া অবৈধ, এবং বেআইনি৷ কেননা, বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭-এর ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে: ‘‘বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে৷’’ এবং ৩(২)-এ বলা হয়েছে: ‘‘উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহা হইলে উহা বে-আইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে৷ সুতরাং, বিটিআরসি কর্তৃক ইংরেজিতে প্রস্তুতকৃত রেগুলেশনটি যদি বর্তমান অবস্থায় কার্যকর হয় তবে তা বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ অনুযায়ী বে-আইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে৷’’
প্রসঙ্গত, গণঅধিকার হরণ এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে চারটি আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছিল৷
সেগুলো হলো প্রস্তাবিত বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন ২০১৬, প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬, বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন ২০১৬ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন ২০১৬৷ সেই সময়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ণ প্রক্রিয়া নিয়ে নাগরিকদের একটি অংশ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছিলেন৷ নাগরিকদের যথার্থ ও প্রয়োজনীয় অংশগ্রহণবিহীন সরকার কি কোনো আইন প্রণয়ণ করতে পারে কি? যদি করে থাকে তবে সেই আইন কি বৈধ?
যদিও নাগরিকদের অংশগ্রহণ ছাড়া আইন প্রণয়ণের প্রক্রিয়া আজও বিদ্যমান এবং প্রশ্নবিদ্ধ৷ পরবর্তীতে ২০১৬ সালে বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন এবং ২০১৮ সালে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হয়, প্রস্তাবিত অপর দু’টি আইন (বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন) সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং সচেতন নাগরিকদের বাধার মুখে প্রণয়ণ করা সম্ভব হয়নি৷ যদিও বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন, ২০১৬ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ প্রণয়নে নাগরিকদের অংশগ্রহণ, প্রস্তাবিত আইন পর্যালোচনায় পর্যাপ্ত সময় ও সমতার সুযোগের পরিছন্নতা, এবং নাগরিকদের নিকট দায়বদ্ধতা ছিল শূন্য থেকে মহাশূন্যময়; যার নেতিবাচক ফল সরাসরিভাবে মানবাধিকার সংগঠনসমূহ এবং নাগরিকেরা ভোগ করেছেন, করছেন এবং সামনের দিনগুলোতে আরও করবেন বলে নাগরিকেরা মনে করেন৷
কারণ অবৈধ এবং নিপীড়নমূলক আইনসমূহ কার্যত রাষ্ট্র, শাসকশ্রেণি, ক্ষমতাধর, ও বিত্তবানদের স্বার্থই রক্ষা করে৷
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান ইতিমধ্যেই ১৪২ অনুচ্ছেদে জরুরি অবস্থা ঘোষণায় মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কি ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যাবে তা বর্ণনা করেছে, কিন্ত, প্রস্তাবিত রেগুলেশনটির ধারা ১১ বাংলাদেশে জরুরি পরিস্থিতিতে তথ্য অবরুদ্ধ করার বিধান করেছে৷ অর্থাৎ, বিটিআরসি দ্বারা প্রদত্ত বিধান বিষয়টি আরও জোরালো করেছে৷ ধারা ১১ এর উপধারা ২ ডিজিটাল নিরাপত্তা সংস্থার মহাপরিচালকের হাতে বিস্তৃত ক্ষমতাও প্রদান করে৷ একইভাবে মহাপরিচালককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং প্রস্তাবিত ডেটা সুরক্ষা আইনের অধীনেও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে৷ একজন ব্যক্তি তিনটি ভিন্ন আইনের অধীনে ক্ষমতা লাভ করলে এই ধরনের ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহারের জন্য ব্যাপক সুযোগ তৈরি হয়৷
রেগুলেশনেটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২১ এর মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা বা প্রচারণার দণ্ড; ধারা ২৭ এর সাইবার সন্ত্রাসী কার্য সংঘটনের অপরাধ ও দণ্ড, এবং ধারা ২৮ এর ওয়েবসাইট বা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ, সম্প্রচার সংক্রান্ত বিষয়ের মত অনুরূপ বিধান রয়েছে৷ এই বিতর্কিত অংশগুলির ব্যাখ্যার জন্য অস্পষ্টতার বিস্তৃত সুযোগ রয়েছে৷ পুনরাবৃত্তি দ্বিগুণ বিপদের কারণ হতে পারে৷
প্রবিধানে অফিসিয়াল তথ্য, পাবলিক তথ্য, ব্যক্তিগত তথ্য, সরকারি গোপনীয়তার লঙ্ঘন, বিভ্রান্তিমূলক, ভুল তথ্য এবং ফেইক-সংবাদের কোনও সংজ্ঞা বা সীমাবদ্ধতা নেই৷ তথ্যচিত্র এবং পডকাস্টের মতো বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিঘ্ন ঘটানোর অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়৷ ভিডিও আকারে শেয়ার করা যেকোনো কিছুই এই প্রবিধানের এখতিয়ারের মধ্যে আসে৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ