গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হলেও সেটাকে বাদ দিয়ে অন্য তিনটি স্তম্ভের ওপর রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার অপচেষ্টা চলছে। তিন পায়ে দাঁড় করিয়ে রাষ্ট্রকে ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে। সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের মাধ্যমে স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অপব্যবহার করে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। এরপর গণমাধ্যম কর্মী আইন নামে সাংবাদিকদের অধিকার ক্ষুণ্ণের আরেকটি কালো আইন পাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে গতকাল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নে এক সাংবাদিকের বাড়িতে হামলা ও ঘরের আসবাব ভাঙচুর করেছে সন্ত্রাসীরা। এ সময় সন্ত্রাসীরা সাংবাদিকের পরিবারের সদস্যদের অকথ্য গালাগাল করে ও তাকে হত্যার হুমকি দেয়।
গত শুক্রবার বিকেলে বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের ভাইয়েরখিল এলাকায় ওই সাংবাদিকের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী ওই সাংবাদিকের নাম সবুজ শর্মা ওরফে শাকিল। তিনি সীতাকুণ্ড প্রেসক্লাবের অর্থ সম্পাদক এবং দৈনিক আজকের পত্রিকার সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি।
সীতাকুণ্ডে যা ঘটেছে
ভুক্তভোগী সাংবাদিক সবুজ শর্মা বলেন, আজ বিকেলে বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান মহসিন জাহাঙ্গীর ও স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল মান্নানের নাম ভাঙিয়ে কয়েকজন সন্ত্রাসী তার বাড়িতে হামলা চালায়। তারা ঘরের ভেতর ঢুকে আসবাব ভাঙচুর করে।
হামলাকারীদের বাধা দিলে তারা তার বৌদি মঞ্জু শর্মা ও বোন শিখা শর্মার ওপর হামলা করে। এর আগে তার বাড়ির দুটি আমগাছের আম পেড়ে নিয়ে যায়।
ইউপি সদস্য আবদুল মান্নান বলেন, সন্ত্রাসীরা কেন তার নাম ভাঙিয়ে হামলা করেছে, তা তার জানা নেই। তিনি এ হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন।
এ বিষয়ে সাবেক চেয়ারম্যান মহসিন জাহাঙ্গীর বলেন, তিনি কোনোভাবে এ হামলার সঙ্গে জড়িত নন। প্রতিপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে তাঁর নাম ব্যবহার করে থাকতে পারে। তিনি এ ঘটনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।
সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, হামলার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী সাংবাদিক সবুজ শর্মার পক্ষ থেকে মামলার প্রক্রিয়া চলছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
সাংবাদিক নির্যাতনের নেপথ্যে কারা?
সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দল বা তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীর নামই বেশি আসে খবরে৷ তবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্য ‘বড় দলগুলোর’, এমনকি তথাকথিত অরাজনৈতিক সংগঠন বা বিভিন্ন পেশাজীবীদের রোষানলেও পড়তে হয় সাংবাদিকদের৷
কয়েক দিন আগে ব্যবসায়ী-শিক্ষার্থী সংঘর্ষের সময়ও তো আহত হলেন ১১ জন সংবাদকর্মী! এবং সংবাদকর্মীদের ওপর তখন হামলা হয়েছে প্রকাশ্যেই৷ পরিচয় গোপনের কোনো চেষ্টাই করেনি হামলাকারীরা৷ তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত একজন হামলাকারীও গ্রেপ্তার হয়নি৷
নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী আর ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সময় একজন সাংবাদিককে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে৷ সেই সাংবাদিক হলেন দীপ্ত টিভির সিনিয়র রিপোর্টার আসিফ সুমিত৷
সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি তথ্য নিচ্ছিলাম, ক্যামেরাম্যান ভিডিও করছিল৷ হঠাৎ করেই কয়েকজন আমাকে ঘিরে ধরলো, তারা বললো, আমরা নাকি সত্যি খবর দেই না৷ এরপরই পেটানো শুরু করলো৷ আমার মাথায় চারটি সেলাই দিতে হয়েছে৷ শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমার পক্ষে মামলা করা সম্ভব ছিল না৷’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু ভিডিওতে তো দেখা যাচ্ছে কারা নির্যাতনকারী৷ পুলিশ চাইলেই তাদের ধরতে পারে৷ কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিশের কোনো কর্মকর্তা আমার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেননি৷ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে এমন কথাও শুনিনি৷ সাংবাদিক নেতাদের কয়েকজন যোগাযোগ করেছেন৷ আমার অফিস আমার পাশে দাঁড়িয়েছে৷ চিকিৎসার খরচও আমার অফিস বহন করছে৷’
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন মনে করেন নির্যাতনকারীদের কঠোর শাস্তি হলে বারবার নির্যাতনের ঘটনা ঘটতো না৷ তিনি বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী৷ বিচারের জন্য আমাদের বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে৷ এই যে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ১২ বছরে পুলিশ ৮৮ বার আদালত থেকে সময় নিয়েছে, অথচ খুনিদের ধরতে পারেনি৷ আমার তো মনে হয়, এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিটাই সাংবাদিকতা পেশাকে আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে৷
কয়েকদিন আগে নীলফামারীর সৈয়দপুর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোকছেদুল মোমিনকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন রংপুরের দৈনিক দাবানলের বিশেষ প্রতিনিধি মোতালেব হক৷ জমি দখল নিয়ে করা সেই প্রতিবেদনের কারণে ক্ষুব্ধ হন মোকছেদুল মোমিন৷ তারপর প্রথমে এক দফা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন মোতালেব৷ তারপর তার ফেসবুক থেকে ছবি নিয়ে তাতে ফটোশপের সহায়তায় জুতোর মালা পরিয়ে পোস্টার বানিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়৷ পোস্টারে লেখা হয়, ‘‘চিহ্নিত চাঁদাবাজ ও হলুদ সাংবাদিক৷’’
আর গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে বালু ব্যবসায়ীরা স্থানীয় সাংবাদিক কামাল হোসেনকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করে৷ তার অপরাধ, জাদুকাটা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সংবাদ পেয়ে ছবি তুলতে গিয়েছিলেন৷ ছবি তোলার এক পর্যায়ে তার ওপর হামলা চালায় বালু ব্যবসায়ীরা৷
শুধু হামলা নয়, প্রচুর মামলারও শিকার হন সাংবাদিকরা৷ ২০২১ সালে শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কমপক্ষে ১ হাজার ১৩৪টি মামলা হয়েছে৷ এই মামলাগুলোর বড় একটা অংশ হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে৷
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, করোনাকালে এবং এর আগে-পরে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সরকারি কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন দল ও বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের রোষানলে পড়ে হামলা, মামলাসহ নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ২১০ জন সাংবাদিক৷
সাংবাদিক নির্যাতনের পরম্পরা
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)-এর মহাসচিব দীপ আজাদ বলেন, ‘সাংবাদিকদের উপর নির্যাতনের বিচার হয় না বলেই নির্যাতনকারীরা বেপরোয়া৷ কয়েকদিন আগেই আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নিহত সাংবাদিকদের বিচারের সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে এসেছি৷ আমরা আশা করেছিলাম, সেই মামলাগুলোর বিচার গতি পাবে? কিন্তু সেটা হয়নি৷
সাংবাদিকরা সব সময় ক্ষমতাধরদের শত্রু! কিন্তু তারা বুঝতে পারেন না, আজ যিনি রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর, কাল তিনি বিরোধী দলে৷ ফলে কাল তিনি বিপদে পড়লে আমরাই তার পক্ষে লিখবো৷
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে খুলনায় হুমায়ুন কবির বালু হত্যাকাণ্ডের পর আমরা শ্লোগান দিয়েছিলাম, ‘বিচার পাই না, তাই বিচার চাই না৷’ কোন অবস্থায় গেলে একজন সাংবাদিক এই ধরনের শ্লোগান দিতে পারে সেটা আপনাকে বুঝতে হবে৷’
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কতজন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার কোনো হিসেব নেই৷ বিভিন্ন মেয়াদের বিচ্ছিন্ন কিছু হিসাব পাওয়া যায়৷ ২০০১ সাল থেকে ২০১৬- এই ১৬ বছরে দেশে ২৩ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন৷ বিএনপির ২০০১-২০০৬ শাসনামলে নিহত হন ১৪ জন সাংবাদিক, আর আহত হন ৫৬১ জন৷ আর ২০০৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে নয় বছরে খুন হন নয় জন সাংবাদিক৷ আরেক পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে বাংলাদেশে ৩৮ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন৷ নির্যাতন বা হত্যাকাণ্ডের এই খতিয়ান পূর্ণাঙ্গ নয়৷ অনেক ঘটনাই রয়ে গেছে আড়ালে৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ