পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে নীরব এলাকা। এখানে শব্দের গ্রহণযোগ্য মান ৪৫ ডেসিবেল, কিন্তু বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) ৮৯ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ শোনা যায়।
ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভোগেন নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যায়। সম্প্রতি বাকৃবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুরাদ আহমেদ ফারুখ ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা মিলে এই গবেষণা করেন।
প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পাঠে মনোযোগহীনতা, মাথা ব্যথা, শ্রবণশক্তির সমস্যা, উদ্বিগ্নতা, অনিদ্রা, স্নায়বিক সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভোগার তথ্য গবেষণায় উঠে এসেছে।
গবেষণার প্রধান মুরাদ আহমেদ ফারুখ জানান, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শব্দ দূষণের মাত্রা নির্ণয়, দূষণের মাত্রা নির্দেশক ম্যাপ তৈরি ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের ওপর দূষণের প্রভাব ইত্যাদি বিষয়কে সামনে রেখে গবেষণা চালানো হয়েছে।
এই গবেষণা করতে গিয়ে গবেষকরা শব্দ দূষণের মাত্রা নির্দেশক ম্যাপ তৈরিতে ব্যবহার করেছেন জিআইএস এবং আরএস প্রযুক্তি। শব্দ দূষণের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার গুরুত্বপূর্ণ ৯টি এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
এসব জায়গা থেকে গড়ে প্রতিদিন তিন হাজারের বেশি ভারী ও মাঝারি মানের যানবাহন চলাচল করে। শব্দ দূষণের মাত্রার ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি রং দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকাকে ওই ম্যাপে উপস্থাপন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো লাল অঞ্চল (৮৫-৮৯ ডেসিবেল) এবং হলুদ অঞ্চল (৮০-৮৪ ডেসিবেল)।
গবেষক আরো জানান, লাল এলাকায় রয়েছে জব্বারের মোড়, কৃষি অনুষদ, প্রশাসনিক ভবন ও কেআর মার্কেট এলাকা। এসব এলাকায় শব্দের তীব্রতা ৮৫-৮৯ ডেসিবেল। ম্যাপের হলুদ এলাকার মধ্যে রয়েছে ভেটেরিনারি অনুষদ, কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদ, পশুপালন অনুষদ, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও জয়নুল আবেদীন মিলনায়তন। এখানে শব্দের তীব্রতা ৮০-৮৪ ডেসিবেল।
লাল এলাকাগুলোয় শব্দের তীব্রতা পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশিত মানের দ্বিগুণের কাছাকাছি। অন্যান্য অঞ্চলের মানগুলোও মানবদেহের সহনশীল মানের চেয়ে অনেক ওপরে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, গবেষণার তথ্যটি আমি জেনেছি। আসলেই এটি একটি শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ার বিষয়। যে যে কারণে এ দূষণগুলো হচ্ছে সেগুলো এ গবেষণার মাধ্যমে চিহ্নিত আছে। আমরা দ্রুত এ শব্দ দূষণ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেব।
শব্দ দূষণে বিশ্বে প্রথম ঢাকা
বায়ুদূষণের পর এবার শব্দ দূষণেও বিশ্বের শীর্ষ স্থানটি দখল করল ঢাকা। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির প্রকাশ করা এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
শব্দ দূষণে ঢাকার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। শব্দ দূষণে বাংলাদেশেরই আরেক শহর রাজশাহী রয়েছে চতুর্থ স্থানে। আর পঞ্চম অবস্থানে ভিয়েতনমের হো চি মিন শহর।
এর আগে একাধিকবার বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শহরের তালিকায় ১ নম্বরে নাম ওঠে রাজধানী ঢাকার। সর্বশেষ গত সপ্তাহে বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় উঠে আসে।
শব্দ দূষণ নিয়ে ‘ফ্রন্টিয়ার্স ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে শব্দ দূষণ কীভাবে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা প্রভাবিত করছে, সে বিষয়েও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শব্দ দূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ শহরের তিনটির অবস্থানই দক্ষিণ এশিয়ায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন বা নির্দেশনা অনুযায়ী মানুষের জন্য ঘরের ভেতর শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর ঘরের বাইরে বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল।
নীরব ঘাতক শব্দ দূষণ
স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুযায়ী, শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবেল বা তার বেশি হলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। অস্ট্রেলিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে জানা গেছে, উচ্চ শব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে একজন মানুষের শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চ শব্দ মানুষের ঘুমেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
শব্দ দূষণে অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। উচ্চ শব্দে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ ও উদ্বেগজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব সমস্যা দেখা দিতে পারে সব বয়সের মানুষেরই। তবে বিশেষভাবে ক্ষতি হতে পারে শিশুদের। দিনের পর দিন শব্দ দূষণের শিকার শিশুদের মনোযোগ দেওয়ার ও কিছু পড়ার ক্ষমতা লোপ পেতে পারে।
শহরের আবাসিক এলাকায় শব্দ বা আওয়াজের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৩৫ থেকে ৪৫ ডেসিবল, আর নগরে-বন্দরে ৪৫-৫০ ডেসিবলের বেশি নয়। কিন্তু আমাদের দেশে শহর, নগর ও বন্দরে শব্দ দূষণের মাত্রা ৮০ থেকে ১০০ ডেসিবলেরও বেশি। এ কারণে শব্দ দূষণের পরিণাম অবশ্যই ভয়াবহ।
শব্দ দূষণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ চিন্তা ও চেতনায় বাধা সৃষ্টি করে। নগরজীবনে স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে শব্দ দূষণ। সম্প্রতি শহর বন্দর নগরে নির্মাণকাজ এবং যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এ সমস্যা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
এতে একদিকে জনগণ যেমন শ্রবণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার ঝুঁকিতে রয়েছেন, সেই সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শব্দ দূষণ দুশ্চিন্তা, অবসাদ, উদ্বিগ্নতা, নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি বাড়িয়ে দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে ৩০টি কঠিন রোগের অন্যতম কারণ হলো শব্দ দূষণ।
এ দেশে ২০০৬ সাল থেকে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা আছে। এই বিধিমালা অনুযায়ী শব্দ দূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু তা আসলে কতটুকু কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হলে আজ হয়তো শব্দ দূষণ এত মারাত্মক হয়ে উঠত না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০৭
আপনার মতামত জানানঃ