স্মার্টফোন আমাদের জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। হালফিলে স্মার্টফোন যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তার প্রয়োজনয়ীতা কতটা! বাদ নেই শিশুরাও। ছোট থেকেই হাতে স্মার্টফোন ও ট্যাবলেট পেয়ে, বড়দেরও কয়েক গোল দিচ্ছে তারা! কানে হেডফোন অথবা ইয়ারফোনও দীর্ঘক্ষণ গুঁজে রাখতে দেখা যায় তাদের। কোভিড পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাসের জনপ্রিয়তার কারণে, এই প্রবণতা আরও বাড়ছে, যা সত্যিই বিপজ্জনক।
হেডফোনের এ ব্যবহার শিশুদের শ্রবণক্ষীণতা বাড়ার একটি কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ডিভাইসটির অতি ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা।
নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘করোনার কারণে দীর্ঘদিন মানুষ ঘরবন্দি ছিল। অনিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইন ক্লাসের কারণে ব্যাপকভাবে কানের ওপর প্রভাবে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত হেডফোন ব্যবহারের কারণে ক্লাসে অমনোযোগীও ছিলেন। ভারতের একটি গবেষণায় আরও উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান উঠে এসেছে।
‘গবেষণা বলছে, অতিরিক্ত হেডফোন ব্যবহারের কারণে ভারতে ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর অনলাইনে ক্লাসে মনোযোগ ছিল না। এসব শিক্ষার্থীর ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। তাদের মাথাব্যথা, চোখব্যথা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কানে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাবে আরও বেশি দৃশ্যমান হবে আরও কয়েক বছর পর। কারণ কানের সমস্যা মানুষ সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করতে পারেন না। যখন গুরুতর হয়, তখন হাসপাতালে আসেন।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ৩০টি কঠিন রোগের কারণ ১২ ধরনের দূষণ। এর মধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম।
শব্দদূষণের কারণে রক্তচাপ বৃদ্ধির পাশাপাশি হৃৎস্পন্দনে পরিবর্তন, হৃৎপিণ্ডে ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমে যেতে পারে। শ্বাসকষ্ট, মাথাঘোরা, বমি বমি ভাব, দিক ভুলে যাওয়া, দেহের নিয়ন্ত্রণ হারানো, মানসিক ক্ষতিসহ বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা তৈরি করে এ দূষণ।
ডা. মনিলাল আইচ বলেন, ‘দেশে গড়ে ৩৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে কানের সমস্যায় রয়েছে। প্রতি তিনজনে একজন গড়ে কানে কম শোনে। এ ছাড়া যেসব কারণে শব্দদূষণ হচ্ছে, এটা কমাতে যেসব নীতিমালা করা হয়েছে, তার একটাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না, যার কারণে শব্দদূষণ বাড়ছে।’
২০১৭ সালের একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শব্দদূষণের দেশ হচ্ছে ঢাকা। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এটা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের কানের সমস্যা দেখা দেবে।’
জাতীয় নাক, কান ও গলা ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মানস রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘দেশে শ্রবণক্ষীণতার প্রধান কারণ শব্দদূষণ। শব্দের একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রা রয়েছে। সাধারণত মানুষের ৮০ ডেসিবল শব্দ গ্রহণের সক্ষমতা রয়েছে।
‘এর চেয়ে বেশি পরিমাণ শব্দের মধ্যে মানুষ নিয়মিত কাজ করলে, কানে সমস্যা দেখা দেয়, কিন্তু রাজধানীসহ সারা দেশেই নগরায়নের প্রভাবে সবখানেই মাত্রাতিরিক্ত শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে।’
হেডফোনের এ ব্যবহার শিশুদের শ্রবণক্ষীণতা বাড়ার একটি কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ডিভাইসটির অতি ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা।
তিনি বলেন, দেশে অনেক মানুষ জন্মগত ও কানপাকা রোগের কারণে কানে কম শোনে। এ ছাড়া দেশে প্রতি বছর প্রায় আড়াই হাজার শিশু জন্মগতভাবে শ্রবণ সমস্যা নিয়ে বেড়ে উঠছে, কিন্তু জাতীয়ভাবে এ সমস্যা শনাক্তে তেমন ব্যবস্থা না থাকায় অনেক পরে এটি প্রকাশ পাচ্ছে।
এ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, জাতীয়ভাবে জন্মের পরপর শিশুর শ্রবণ শনাক্তের ব্যবস্থা থাকলে এ সমস্যা অনেক কমে আসত। এ ছাড়া দেশে তরুণ সমাজের মধ্যে যে হারে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, বিশেষ করে কানে অনিয়ন্ত্রিত ইয়ার প্লাগ ব্যবহার বাড়ছে, তাতে করে ধীরে ধীরে শ্রবণক্ষীণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করেছে। সেখানে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে, কিন্তু তার সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের।
বিশ্ব শ্রবণ দিবস-২০২২ উপলক্ষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জীবনভর ভালো শ্রবণশক্তি বজায় রাখার উপায় হিসেবে নিরাপদ শ্রবণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।
এর আগে ২০২১ সালে ডব্লিউএইচও শ্রবণ সংক্রান্ত বিশ্ব প্রতিবেদন চালু করে, যেখানে শ্রবণশক্তি হারানোর ঝুঁকিতে থাকা মানুষের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাকে তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি উচ্চ শব্দ কমানোর ওপর গুরুত্বরোপ করা হয়।
ডব্লিউএইচও বলছে, কানের যত্নের মাধ্যমে সারা জীবন ভালো শ্রবণশক্তি পাওয়া সম্ভব; শ্রবণশক্তি কমার অনেক সাধারণ কারণ প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
শব্দদূষণ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সারা বিশ্বের মতো বৃহস্পতিবার দেশে পালন হচ্ছে বিশ্ব শ্রবণ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপ্রাদ্য ‘টু হিয়ার ফর লাইফ, লিসেন উইথ কেয়ার!’ এর মানে দাঁড়ায়, ‘জীবনভর শুনুন, যত্নের সঙ্গে শুনুন’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডাব্লিউএইচও-র উদ্যোগে ২০০৭ সালের এই দিনে প্রথমবারের মতো পালিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার কেয়ার ডে’ বা আন্তর্জাতিক কর্ণ যত্ন দিবস। তখন শব্দদূষণকে শ্রবণ হ্রাসের প্রধাণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনের জন্য প্রচারণা চালানো হতো। কানের বহিরাংশ না বহিকর্ণ দেখতে ইংরেজি সংখ্যা তিন বা থ্রির মতো। তাই ইংরেজি বছরের তৃতীয় মাস অর্থাৎ মার্চ মাসের তৃতীয় দিনকে বিশ্ব কানের যত্ন দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বলা হয়েছে।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশে বেশি অর্থাৎ ৩৬০ মিলিয়ন মানুষ শ্রবণে অক্ষম। বংশগত কারণ, জন্মগত জটিলতা, নির্দিষ্ট সংক্রামক রোগ, ক্রনিক কানের সংক্রমণ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, অত্যধিক শব্দ এবং বার্ধক্যজনিত কারণে সাধারণত শ্রবণশক্তি হ্রাস হয় বা শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শ্রবণশক্তি হ্রাসের বিষয়ে মনোযোগের অভাবে বিশ্বব্যাপী ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক খরচ হয় যা ক্ষতিগ্রস্তদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বিশ্বে ৪৬৬ মিলিয়ন মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস হয় যাদের মধ্যে ৩২ কোটি শিশু। অথচ এই শিশুদের শ্রবণশক্তি হ্রাস বেশিরভাগই প্রতিরোধযোগ্য। শৈশবে শ্রবণ শক্তি হারানোদের ৬০ ভাগই প্রতিরোধযোগ্য। আর যারা শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন তারা প্রাথমিক সনাক্তকরণ এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জানিয়েছে, আনুমানিক ৪৬৬ মিলিয়ন মানুষ শ্রবণহ্রাস নিয়ে বেঁচে আছেন। সঠিক ও সময়োপযোগী ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৬৩০ মিলিয়ন। তাই আগামী বছরগুলোতে এই বিপুলসংখ্যক শ্রবণশক্তি হ্রাস ঠেকাতে যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহন, শ্রবণশক্তি হ্রাসকারীর প্রয়োজনীয় পূনর্বাসন সেবা এবং যোগাযোগ সরঞ্জাম সহজভাবে নিশ্চিত করা জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হেডফোন ও ইয়ারবাডস ব্যবহার, শিশুদের শ্রবণ সমস্যা বাড়িয়ে তুলবে। কম বয়সে অত্যাধিক ইয়ারফোন অথবা হেডফোন ব্যবহারের কারণে, শিশুদের শ্রবণ যন্ত্রের পরিপক্কতা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা। আজকাল শিশু, কিশোর ও অল্প বয়সীরা দিনে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ৭০ ডেসিবেলেরও অধিক শব্দ হেডফোনের মাধ্যমে শুনতে থাকে, যা তাদের কানের পাকাপাকিভাবে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৩
আপনার মতামত জানানঃ