সাম্প্রতিক সময়ে বিক্ষোভে উত্তাল শ্রীলঙ্কা। লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবি করছেন।
এদিকে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে তার বাসভবন ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেছেন দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী।
রোববার(২৪ এপ্রিল) তারা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে এ বিক্ষোভ করেন। এ সময় পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙে শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেন। খবর এএফপির।
বিক্ষোভকারীরা যাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে যেতে না পারেন, সে জন্য রোববার রাজধানী কলম্বোর বিভিন্ন সড়কে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে পুলিশ।
কিন্তু পুলিশি ব্যারিকেড পেরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে যান বিক্ষোভরত হাজার হাজার শিক্ষার্থী।
দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অজ্ঞাত এক ছাত্রনেতা বলেন, ‘আপনি রাস্তা অবরোধ করতে পারেন, কিন্তু পুরো সরকার ঘরে না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম থামাতে পারবেন না।’
অনেককে ‘বিদায় নাও গোতা’সংবলিত প্ল্যাকার্ড বহন করতে দেখা যায়। মাহিন্দা রাজাপাকসের ছোট ভাই ও দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের ডাকনাম এটি। কেউ কেউ আবার সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক গাই ফকস মুখোশ পরিধান করেন।
পুলিশ জানিয়েছে, ওই সময় শ্রীলঙ্কার শাসক পরিবারের শীর্ষ ব্যক্তি মাহিন্দা রাজাপাকসের বাসভবনে ছিলেন না। শান্তিপূর্ণভাবেই বিক্ষোভ শেষ হয়েছে।
এদিকে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে প্রতিদিন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের সমুদ্রতীরবর্তী বাড়ির সামনে জড়ো হচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। তাঁরা প্রেসিডেন্ট এবং তার ভাইয়ের (প্রধানমন্ত্রী) পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ করে আসছেন। দেশজুড়ে সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের বাড়ি ও কার্যালয়ে বিক্ষোভকারীদের চড়াও হওয়ার চেষ্টা করতে দেখা গেছে।
চলতি সপ্তাহে মধ্যাঞ্চলীয় শহর রাম্বুক্কানায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হন। গত মাসে শুরু হওয়া বিক্ষোভে এটি ছিল প্রথম কোনো প্রাণহানি।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন ও প্রবাসী আয়ে ধাক্কা লাগলে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ধসে পড়ার বিষয়টি সামনে আসে। দেশটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির অর্থ জোগাতে ব্যর্থ হয়। এতে চাল, গুঁড়া দুধ, চিনি, ময়দা ও ওষুধের সরবরাহ কমে যায়। লাগামহীন মূল্যস্ফীতি দুর্ভোগ আরও বাড়ায়।
জ্বালানি–সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় দিনের অধিকাংশ সময় লোডশেডিং হচ্ছে। সময় ভাগ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিদিন সকালে পেট্রল ও কেরোসিনের জন্য মানুষকে সার্ভিস স্টেশনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়।
এদিকে দেশটির অর্থমন্ত্রী আলি সাবরি গত শুক্রবার সতর্ক করে বলেছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ঋণের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে বর্তমানে ওয়াশিংটনে অবস্থান করছেন তিনি।
‘আপনি রাস্তা অবরোধ করতে পারেন, কিন্তু পুরো সরকার ঘরে না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম থামাতে পারবেন না।’
১৯৪৮ সালে ব্রিশিট শাসন থেকে মুক্তি লাভের পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে এই দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। খাদ্য সঙ্কট, মূল্যস্ফীতি এবং বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দেশটির এসব সঙ্কটের জন্য সরকারকেই দায়ী করা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানীতে এসেছে পড়েছে। এটাকেই অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সঙ্কট বলা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা না থাকার অর্থ হলো প্রধান খাদ্যপণ্য এবং জ্বালানী আমদানীর জন্য যথেষ্ট অর্থ নেই। ফলে খাদ্য সঙ্কট এবং মূল্যস্ফীতি প্রকট আকার ধারণ করেছে।
একটানা গত ছয় মাস দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। ষষ্ঠ মাসে এসে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে দেশটির মূল্যস্ফীতি। এই অবস্থায় জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) অনুরোধ জানিয়েছে দেশটি।
এক বছরের ব্যবধানে গত মার্চে দেশটির বোর্ড ভিত্তিক জাতীয় ভোক্তা মূল্য সূচক (এনসিপিআই) বেড়েছে ২১.৫ শতাংশ যা গত বছরের তুলনায় চার গুণেরও বেশি। গত বছর মার্চে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ।
দেশটির আদমশুমারি ও পরিসংখ্যান বিভাগের দেয়া সর্বশেষ তথ্যানুসারে, মার্চে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ২৯ দশমিক ৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। তা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ডিজেলের দাম ৬৪ দশমিক ২ শতাংশ বাড়িয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অচলাবস্থার ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। এদিকে দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি অভিযোগ এনে তার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ চলছে দেশজুড়ে। বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গত মঙ্গলবার মধ্য শ্রীলঙ্কার রামবুক্কানা শহরে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের ছোড়া গুলিতে একজন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন প্রায় ৩০ জন।
সরকার এ পরিস্থিতির জন্য করোনা মহামারিকে দায়ী করছে। সরকার বলছে মহামারির কারণে পর্যটন ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে। তাছাড়া তিন বছর আগে দেশটিতে ভয়াবহ বোমা হামলার কারণেও পর্যটক কমে গেছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছে, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাই বর্তমান সঙ্কটের জন্য দায়ী।
এক দশক আগেও শ্রীলঙ্কা ছিল অন্য রকম; তামিল টাইগাররা পর্যুদস্ত, গৃহযুদ্ধের অবসানে দেশটি যেন উড়ছিল। পর্যটননির্ভর দ্বীপরাষ্ট্রটির অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠছিল; আসছিল বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার; তা রোশনাই ছড়াচ্ছিল দোকানগুলোতে, আর সড়কে দেখা মিলছিল চকচকে সব গাড়ির।
আর দশককাল বাদে সেই শ্রীলঙ্কায় সড়কে এখন বাতি জ্বলছে না, গাড়ি চালাতে মিলছে না জ্বালানি তেল, কাগজের অভাবে পরীক্ষা নেওয়া যাচ্ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী।
বিশাল অঙ্কের ঋণ, তার সঙ্গে মহামারীর খাঁড়ার পর ইউক্রেইন যুদ্ধ একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে সোয়া ২ কোটি মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কাকে। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এতটাই কমেছে যে তা দিয়ে এক মাসের আমদানি ব্যয়ও মেটানো যাবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৫
আপনার মতামত জানানঃ