সংবিধান, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও দেশে থেমে নেই হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু। এরই ধারাবাহিকতায় লক্ষ্মীপুরে চেক জালিয়াতি মামলায় গ্রেপ্তারের পর আবদুল কুদ্দুস নামে এক ফার্মেসি ব্যবসায়ীর পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে।
বুধবার(২০ এপ্রিল) রাত ১১ টার দিকে সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
পুলিশী হেফাজতে তার এ মৃত্যুর ঘটনাটি সদর থানা পুলিশকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
আব্দুল কুদ্দুস সদর উপজেলার বাংগাখাঁ ইউনিয়নের রাধাপুর গ্রামের আবদুল্লাহ চৌধুরীর ছেলে। তিনি লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেঘনা রোড এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা।
আব্দুল কুদ্দুছের আত্মীয় পরিচয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সদর হাসপাতালের সামনে জানান, রাতে তাকে সুস্থ অবস্থায় পুলিশ গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে অসুস্থ হয়েছেন বলে পুলিশ তাকে হাসপাতাল নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তার আবদুল কুদ্দুসকে মৃত ঘোষণা করেন।
ওই আত্মীয়ের দাবি, পুলিশ হেফাজতে একজন সুস্থ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া মৃত্যুর পরে পুলিশের দায়িত্বে হাসপাতাল থেকে মরদেহ তড়িঘড়ি করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই পরিবারে কাছে হস্তান্তরের জন্য নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়। পরে সাংবাদিকদের উপস্থিতির কারণে এ প্রচেষ্টা থেমে যায়। বিষয়টি নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্টি হয় বলে জানান আত্মীয়রা।
এ ঘটনায় পুলিশ জানায়, ঢাকার ওয়ারী থানায় কুদ্দুসের বিরুদ্ধে একটি চেক জালিয়াতি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এতে নির্দেশনা পেয়ে সদর থানা পুলিশ তাকে বুধবার রাত পৌনে নয়টার দিকে লক্ষ্মীপুরের মেঘনা রোড এলাকার ফার্মেসি দোকান থেকে গ্রেপ্তার করে। খবর পেয়ে তার স্ত্রী নিগার সুলতানা স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর মো. আল-আমিনকে নিয়ে থানায় যান। পুলিশের দাবি, তাদের উপস্থিতিতেই কুদ্দুস অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) আনোয়ার হোসেন দাবি করেন, কুদ্দুস স্ট্রোক করেছেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মিমতানুর রহমান বলেন, মরদেহ ময়নাতদন্তসহ বিষয়টির তদন্ত করা হবে।
দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা বন্দুকযুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা আগের থেকে কমলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু আবারও অত্যন্ত উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে বলে সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। মার্চ মাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনা করে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে।
মার্চ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। অপরদিকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের পর দুইজনের কারাগারে মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নির্যাতনের একপর্যায়ে ভয়ে পালিয়ে যাওয়া অভিযুক্তকে মৃত অবস্থায় ডোবা থেকে উদ্ধার, থানার ভেতরে অন্তঃসত্ত্বার পেটে লাথি মেরে গর্ভপাত ঘটানো, দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় থানার ভেতরে দুই ব্যক্তিকে নির্যাতন ও হাসপাতালে জরুরি বিভাগে কর্মরত ব্রাদারকে মারধর করা এবং আরেক ঘটনায় এক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নিজ স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে।
এমএসএফ মনে করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ ও পরবর্তীতে কারা হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুতর ও অগ্রহণযোগ্য। ঘটনাগুলোর তদন্তপূর্বক জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক।
এমএসএফের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসে কারা হেফাজতে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে মধ্যে ছয়জন কয়েদি ও এক বিদেশি নারীসহ চারজন হাজতি।
কারাগারে অপর্যাপ্ত চিকিৎসার কারণে বন্দিরা যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বন্দি অসুস্থ হলে তাকে কারাগারের বাইরে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, নয়তো হাসপাতালে নেয়ার আগেই অধিকাংশ বন্দির মৃত্যু হয়।
এমএসএফ বিশ্বাস করে যে কারাগারের অভ্যন্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাগুলো সঠিকভাবে তদন্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে’ (৩১ অনুচ্ছেদ)। নবম সংসদে পাস করা ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) বিল, ২০১৩ ’-এ সরকারের হেফাজতে থাকা অবস্থায় কারও ওপর নির্যাতন চালানোকে অপরাধ বলে বর্ণনা করে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির বিধান করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আইন বলছে, ‘হেফাজতে মৃত্যু’ বেআইনি কাজ, অপরাধ। তারপরও এর বিচার হয় না। ২০১৩ সালের আইনে এ পর্যন্ত বিচার হয়েছে একটি।
হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার বিচার হয় না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার অভিযোগও করে না। পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা নেওয়ার উদাহরণ বিরল বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। কিন্তু অভিযোগ না করেও পরিবারের যেসব অভিজ্ঞতা তা জানলেই বোঝা যায়, কেন কারও পক্ষে অভিযোগ করার সাহস দেখানো সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে হত্যাকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের মানসিকতাই যে সহযোগী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই কাজে পরোক্ষ ভূমিকা পালনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও যে পিছিয়ে নেই, তা এই প্রতিষ্ঠানের নির্লিপ্ততাতেই স্পষ্ট। কমিশন একবার বলেছিল যে বেছে বেছে কয়েকটা ঘটনার তদন্ত করবে, সেই কথা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কমিশনের জবাবদিহির অভাব পুলিশ এবং সরকারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
তারা বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ নিজেরাই তদন্ত করে, ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, যে পুলিশ মামলাই নিতে চায় না, তার হাতে তদন্তের ভার দিলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কারণ নেই। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য কোনো স্বাধীন কমিশন গঠনের ইচ্ছা বা আগ্রহ যে সরকারের নেই, তা-ও সহজেই বোধগম্য।
আরও বলেন, পুলিশের কর্মকর্তারা একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছেন, যেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল করে দেওয়া হয়। এই দাবি একেবারে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে এমন নয়। তদুপরি, পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতে এই বাহিনীর সদস্যরা যে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বেই ভাববেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই; হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা সেগুলো প্রতিদিন প্রমাণ করে দিচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৭
আপনার মতামত জানানঃ