নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটের ফলে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে শ্রীলঙ্কায় সরকারপতন আন্দোলন চলছে। গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটের জেরে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে শ্রীলঙ্কায় চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভে প্রথমবারের মতো গুলি চালিয়েছে দেশটির পুলিশ। এতে অন্তত একজন নিহত ও আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার(১৯ এপ্রিল) কলম্বো পুলিশের একজন মুখপাত্র বিক্ষোভে গুলি চালানোর তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেছেন, পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ এবং বিক্ষোভ সহিংস আকার ধারণ করায় গুলি চালানো হয়েছে।
জ্বালানির তীব্র সংকট ও এর মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) মধ্য শ্রীলঙ্কার রামবুক্কানায় একটি মহাসড়ক অবরোধ করেন বিক্ষোভকারীরা। এদিন টায়ার জ্বালিয়ে রাজধানী কলম্বোয় যাওয়ার প্রধান সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায় হাজার হাজার মানুষ। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়।
তেলের তীব্র ঘাটতি এবং উচ্চ মূল্যের প্রতিবাদে মঙ্গলবার রাজধানী কলম্বো থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরের রামবুক্কানা শহরে সড়ক অবরোধ করে লোকজন বিক্ষোভ করেছেন। জ্বালানির তীব্র ঘাটতির কারণে শ্রীলঙ্কাজুড়ে মঙ্গলবার বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। এ সময় তারা রাজধানীমুখী সড়ক অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন।
লঙ্কান সংবাদমাধ্যম ডেইলি মিরর জানিয়েছে, বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে আহত বিক্ষোভকারীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। এসময় এক বিক্ষোভকারী হতাহতের ঘটনার জন্য পুলিশকে দায়ী করছিলেন।
গুলির ঘটনার পর বিক্ষোভকারীরা রামবুক্কানা থানা ঘিরে রেখেছেন এবং থানা ভবনের দিকে অবিরত পাথর ছোড়া হচ্ছে। বিকেলে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করেছিল পুলিশ।
হাসপাতাল ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, তেলের ঘাটতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে রামবুক্কানাতে একটি মহাসড়ক অবরোধ করেন বিক্ষোভকারীদের একটি দল। বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে তাজা গুলি বর্ষণ করে পুলিশ।
রাজধানী কলম্বো থেকে দূরে এই শহরটি অবস্থিত। মহাসড়কটি ক্যান্ডি শহরকে কলম্বোর সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।
পুলিশের এক মুখপাত্র স্বীকার করেছেন, বিক্ষোভকারীরা সহিংস হয়ে উঠলে এবং ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছে।
লঙ্কান সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে দেশটির প্রধান খুচরা তেল বিক্রেতা সিলন পেট্রোলিয়াম করপোরেশন মঙ্গলবার ৬৪ দশমিক ২ শতাংশ পর্যন্ত তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। গত সপ্তাহে রেশনিং ব্যবস্থাও বাতিল করেছে তারা।
এ অবস্থায় লঙ্কান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা বিক্ষোভে যোগ দেন দেশটির গাড়িচালকরা। মঙ্গলবার শ্রীলঙ্কার প্রধান শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকরাও ওষুধ-চিকিৎসা সরঞ্জাম ঘাটতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু করেছেন।
তেলের ঘাটতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে রামবুক্কানাতে একটি মহাসড়ক অবরোধ করেন বিক্ষোভকারীদের একটি দল। বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে তাজা গুলি বর্ষণ করে পুলিশ।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর এবারই প্রথম সবচেয়ে বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে শ্রীলঙ্কা। দেশটিতে নিত্য-প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্যসামগ্রীর তীব্র সঙ্কট চলছে। আমদানিতে বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় দ্রব্যমূল্য আকাশ ছুয়েছে। উৎপাদনে ভাটা পড়ায় দিনের বেশিরভাগ সময়ই বিদ্যুৎবিহীন থাকতে হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপ রাষ্ট্রের বাসিন্দাদের।
মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকায় দেশটিতে হু হু করে বাড়ছে খাদ্য-ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না দেশটি। ফলে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে শ্রীলঙ্কার গণপরিবহন ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা।
বিদ্যুৎ-খাদ্য-ওষুধ-জ্বালানি সংকটে অতিষ্ঠ শ্রীলঙ্কার জনগণ গত কিছু দিন ধরে সড়কে অবস্থান নিয়েছেন এবং সরকারের পদত্যাগের দাবিতে কলম্বোসহ দেশের সব বড় শহরে আন্দোলন শুরু করেছেন তারা। জনগণের ক্ষোভের মুখে ইতোমধ্যে মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য পদত্যাগ করেছেন।
এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে দ্রুত আর্থিক সহায়তার আবেদন করেছে শ্রীলঙ্কা এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই আর্থিক সংস্থা সেই আবেদন বিবেচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মঙ্গলবার দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।
সোমবার ওয়াশিংটনে শ্রীলঙ্কার নতুন অর্থমন্ত্রী আলি সাবরির নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়েছে আইএমএফ কর্মকর্তাদের। বৈঠকে কর্মকর্তারা বলেছেন, বিশেষ প্যাকেজ র্যাপিড ফিন্যান্সিয়াল ইনস্ট্রুমেন্টের (আরএফআই) আওতায় শ্রীলঙ্কাকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে আইএমএফ।
কোনো দেশ জরুরিভিত্তিতে আর্থিক সহায়তার প্রয়োজনবোধ করলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আরএফআইয়ের জন্য আবেদন করতে পারে। কোনো দেশ বা সংস্থায় জরুরিভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা পাঠানোর জন্যই এই প্যাকেজ চালু করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল।
এর আগে শ্রীলঙ্কা সরকার আরএফআই প্রকল্পের আওতায় জরুরি আর্থিক সহায়তা চেয়ে আবেদন করেছিল, কিন্তু আইএমএফ প্রথমে সেই আবেদন মঞ্জুরে আগ্রহী ছিল না।
লঙ্কান অর্থমন্ত্রীর সহকারী শামির জাভাহির বলেছেন, ওয়াশিংটনের বৈঠকে আইএমএফ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শ্রীলঙ্কাকে আরএফআই প্রদানের জন্য ভারত অনুরোধ জানিয়েছে এবং এই অনুরোধের পরই তারা আবেদন বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রজুড়ে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ক্ষোভ এবং হতাশা। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে হাজারও শ্রীলঙ্কান প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিক্ষুব্ধ জনতা একটি স্লোগানই দিচ্ছেন, ‘চলে যাও গোতা, চলে যাও’।
গোতা হলেন শ্রীলঙ্কার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসে। বর্তমানে দেশটি যেই চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য তিনি অনেকাংশেই দায়ী।
শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায়, সরকার জ্বালানি ও এর মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আমদানির জন্য অর্থ প্রদান করতে পারেনি। এর পাশাপাশি মহামারিজনিত বিধিনিষেধের কারণে দেশের পর্যটন শিল্পেরও ব্যপক ক্ষতি হয়েছে। তবে অনেকেই এ সবকিছুর সঙ্গে প্রেসিডেন্টের অব্যবস্থাপনাকেই চলমান সংকটের জন্য দায়ী করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে নির্বাচিত হওয়ার পর তার প্রবর্তিত নীতিগুলোর কারণেই সংকট আরও বেড়েছে। ট্যাক্স কমানো, আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সাহায্য নিতে অনিহা ইত্যাদি নীতির সমালোচনা করছেন তারা।
শ্রীলঙ্কা তার স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। দেশটির নেতারা এ সংকটকে ২০১৯ সালের এপ্রিলের ইস্টার বোমা হামলা ও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ মহামারির ফল বলে দাবি করে দায় এড়াতে চাইলেও বাস্তবতা আদতে তা নয়।
নিশ্চিতভাবেই এ দুটি ধাক্কা দেশের পর্যটনশিল্পে উল্লেখযোগ্যভাবে পর্যটনপ্রবাহকে হ্রাস করেছে এবং অর্থনৈতিক খাতে এটি কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
কাপড় ইস্ত্রি করার জন্য পুরোনো কাঠকয়লার আয়রন মেশিন আর কেরোসিন দিয়ে জ্বালানো বাতির ব্যবহার বাড়ছে শ্রীলঙ্কায়। অনেকের কাছে এটি সৌখিন বলে মনে হলেও আসলে চরম আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা।
বিদ্যুৎ বিভ্রাট, গ্যাস ও পানির তীব্র সংকট, খাদ্য সংকট, প্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশচুম্বী দামসহ নানা সমস্যার বেড়াজালে আটকা পড়েছে শ্রীলঙ্কার মানুষ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২২২৮
আপনার মতামত জানানঃ