নারীর প্রতি সহিংসতা সভ্য জগৎ ব্যবস্থার প্রতি কঠোর কশাঘাতস্বরূপ। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, নারীকে পদে পদে হেয় বা অবমাননা করা, সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা, নারীর অর্জন বেহাত করা, জোর খাটানো, গৃহস্থালিতে সম্পৃক্ত নারীর কাজের অবমূল্যায়ন, অ্যাসিড দিয়ে মুখ ঝলসে দেওয়া, যৌন ও অন্যান্য নির্যাতন-নিপীড়নের পাশাপাশি নারী তথা মানব সভ্যতায় সহিংসতার সবচেয়ে মারাত্মক ও ভয়ংকর রূপ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে ধর্ষণ।
এদিকে ব্রিটেনের অন্তত ৫৬ এমপির বিরুদ্ধে যৌন অসদাচরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। পার্লামেন্টের অভিযোগ তদন্তকারী আইসিজিএস-এর কাছে এসব অভিযোগ রিপোর্ট করা হয়েছে। সানডে টাইমসের বরাত দিয়ে ডেইলি মেইল জানিয়েছে, ওই ৫৬ এমপির বিরুদ্ধে প্রায় ৭০টি যৌন অসদাচরণের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে গুরুতর অপরাধের অভিযোগও রয়েছে।
সানডে টাইমস বলছে, কোনো তৃতীয় পক্ষ এই অভিযোগগুলো এনেছে এবং অভিযোগগুলো এখনও প্রমাণিত হয়নি। যদিও এর আগেও বৃটেনের পার্লামেন্ট সদস্যদের বিরুদ্ধে এ ধরণের ব্যাপক অভিযোগ এসেছে। গত সপ্তাহেই এমপি ইমরান আহমদ খান যৌন হয়রানির অভিযোগে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালে তিনি ১৪ বছরের একজনকে যৌন হয়রানি করেছিলেন।
এর আগে কনজার্ভেটিভ দলের এমপি ডেভিড ওয়ারবারটনও নারীদের শারীরিকভাবে যৌন হেনস্থা করার অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছিলেন।
এছাড়া গত বছর ধর্ষণের অভিযোগে অজ্ঞাত এক কনজার্ভেটিভ এমপিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল দেশটিতে।
সাবেক কনজার্ভেটিভ এমপি চার্লি এলফিকের বিরুদ্ধেও যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনা হয়েছিল। বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগানো ‘মিটু আন্দোলনের’ প্রেক্ষিতে বৃটিশ এমপিদের এ ধরণের ব্যবহার প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে।
স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) দুই এমপির বিরুদ্ধেও যৌন হেনস্থার অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। প্যাট্রিক গ্রাডি এবং প্যাট্রিসিয়া গিবসন নামের ও দুই এমপির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। ২০১৬ সালে বড়দিনের এক পার্টিতে যৌন হেনস্থার অভিযোগ রয়েছে গ্লাসগো নর্থের এমপি গ্রাডির বিরুদ্ধে। অপরদিকে, নর্থ আয়ারশায়ার এন্ড অ্যারানের এমপি গিবসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পার্লামেন্টের স্ট্রেঞ্জার্স বারের সদস্যদের নিয়ে অসংগতিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। এসব অভিযোগ নিয়ে এসএনপি দলের এক মুখপাত্র গণমাধ্যমকে বলেন, যতক্ষণ এসব অভিযোগের তদন্ত চলছে ততক্ষণ এ নিয়ে মন্তব্য করা আইনত ভাবে উপযুক্ত কাজ হবে না।
এদিকে লন্ডনে যারা ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে যান, তাদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ ভুক্তভোগী এক মাসের মধ্যে নিজেদের অভিযোগ থেকে সরে আসেন। দুই বছরে সেই হার তিন গুণ বেড়ে যায় বলে সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে।
লন্ডনের ইনডিপেনডেন্ট ভিকটিমস কমিশনার ক্লাইরে ওয়াক্সম্যান গবেষণায় সতর্কতা প্রকাশ করেছেন যে, ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিশেষ করে নারীরা ন্যায়বিচার পাওয়ার চেষ্টা থেকে অপমানিত হয়ে নিরুৎসাহিত হচ্ছে।
যারা পুলিশের কাছে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেছেন, তাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ অভিযোগ থেকে সরে এসেছেন। দুই বছর আগে লন্ডনে করা শেষ জরিপের ফলের তুলনায় এই হার সাত শতাংশ বেশি।
৫৬ এমপির বিরুদ্ধে প্রায় ৭০টি যৌন অসদাচরণের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে গুরুতর অপরাধের অভিযোগও রয়েছে।
ব্রিটেনে যদিও করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধের মধ্যে সামগ্রিক অপরাধ কমেছে, কিন্তু দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস থেকে বলা হয়েছে, রেকর্ডকৃত যৌন অপরাধ ৮% বৃদ্ধি পেয়েছে।
ব্রিটিশ সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেদেশের পুলিশ ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ধর্ষণ অপরাধের রেকর্ড সংখ্যক কেস নথিবদ্ধ করেছে।
ব্রিটেনের পারিবারিক সহিংসতার বিষয়ে সহায়তা দেয় দ্য ন্যাশনাল ডমেস্টিক অ্যাবিউজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, সম্প্রতি তাদের হেল্পলাইনে সাহায্য চাওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে। যখন লকডাউন ছিল না, তখনকার তুলনায় বর্তমানে সাহায্য চাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ২৫ শতাংশ। ঘরে আটকে থাকার ফলে নারীরাই মূলত তাদের বন্ধু বা স্বামীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
যুক্তরাজ্যে নারীদের প্রতি যে সহিংসতা মহামারি আকার ধারণ করেছে তা বন্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। জানা গেছে গত বছর যুক্তরাজ্যে কমপক্ষে ১০৮ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। যার অধিকাংশ ঘটনার সঙ্গেই পুরুষরা জড়িত।
গতবছর যুক্তরাজ্যে ১৫ লাখের বেশি নারী অভ্যন্তরীণ সহিংসতার শিকার হয়েছেন। দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ লাখের বেশি নারী তাদের স্বামী, বয়ফ্রেন্ড,অথবা সাবেক স্বামীর হাতে সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
জাতীয় পরিসংখ্যান অফিসের রিপোর্টে বলা হয়, প্রায় ৮৮৮ জন নারী তাদের বর্তমান পার্টনারের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, সম্পর্ক ছেদের প্রথম মাসে নিহত হয়েছেন ১৪২ জন নারী।
এক পুলিশ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত যখন যুক্তরাজ্যে কোয়ারেন্টাইনের নির্দেশ দেয়া হয়; এই সময় নারীদের গৃহে হেনস্তা শিকারের মাত্রা ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের পুলিশ ফেডারেশন শুধুমাত্র এক বছরেই ১৭ লাখের বেশি নারীর প্রতি অভ্যন্তরীণ সহিংসতার মামলা রেকর্ড করেন। এই সময়ে জাতীয় সহিংসতা হেল্পলাইনে কলের সংখ্যা ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
যুক্তরাজ্যের নারীদের রক্ষার জন্য কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন, নারী এবং স্ত্রী লিঙ্গের মানুষ হত্যার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এমন একটি সংগঠন ‘ফেমিসাইড সেনসাস’ ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সংগ্রহ করা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই দশ বছরে যুক্তরাজ্যে ১ হাজার ৪২৫ জন নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আরেকটি সংগঠন ‘নিয়া এন্ডিং ভায়োলেন্স’ জানিয়েছে, ২০২১ সালের প্রথম দুই মাসে ২৫ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর জানিয়েছে, স্ত্রী লীঙ্গের মানুষেদের হত্যার সঙ্গে বৈবাহিক অবস্থার কোনো সম্পর্ক নেই। সবথেকে সহিংসতার শিকার হন ২০ থেকে ২৪ বছরের মেয়েরা। আবার বিবাহিত নারীদের থেকে ডিভোর্সড নারীরা বেশি সহিংসতার শিকার হন।
নারীদের নিরাপত্তার জন্য ‘ওয়াক সেইফ’ নামের একটি অ্যাপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এমা কে বলেছেন, মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে অনেক নারীকে হত্যা করা হয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে আর নয়। যুক্তরাজ্যের নারীরা এখন থেকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আমাদের অবশ্য নিরাপদে রাস্তায় চলতে দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটি উন্নত ও মানবাধিকারসম্পন্ন নিরাপদ পৃথিবী গঠনের জন্য নারীর প্রতি সহিংসতা, বিশেষ করে ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধগুলোর প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা অত্যন্ত জরুরি। এ কথাও সত্য যে, সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করার পরও অন্য যে কোনো অন্যায় বা অপরাধের মতো আমরা হয়তো যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণ পুরোপুরি প্রতিরোধ বা বন্ধ করতে পারব না; তবে সচেতনতা, সতর্কতা, সামাজিক ও আইনি প্রতিকার এ সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনতে পারে।
প্রতিটি নারীর অন্তর্নিহিত শক্তি বা নিজের প্রতি বিশ্বাস এবং তার অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি, স্বকীয় জীবন বিকাশে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে, অন্যায় প্রতিরোধে নারীকে এমনভাবে ক্ষমতায়িত করতে হবে, যেন তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শেখে যে ‘না’ বলার ও ‘আত্মরক্ষার’ অধিকার ও সক্ষমতা তার রয়েছে।
তারা বলেন, নারীকে ‘মানুষ’ নয়; ‘ভোগের সামগ্রী’ হিসাবে ভাবার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন করতে হবে। প্রথমেই প্রয়োজন ধর্ষণ-সংস্কৃতিকে উসকে দেয়, প্রশ্রয় দেয়; তেমন সমাজকে ধর্ষণবিরোধী, ধর্ষণ প্রতিরোধী সমাজে রূপান্তর করা।
এর জন্য গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে নারীকে ‘যৌন পণ্য’ হিসাবে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। নারীকে ‘মানুষ’ হিসাবে ভাবার সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। অন্যদিকে সমাজে যেসব মিথ ও ভ্রান্ত ধারণা ধর্ষণকে প্রশ্রয় দেয়, তেমন মিথগুলোকে ভেঙে দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫১
আপনার মতামত জানানঃ