মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের অত্যাচারে নিহত হিয়েছিলেন জর্জ ফ্লয়েড নামে এক ব্যক্তি। কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়েছেন, এই অভিযোগে উত্তাল হয়ে উঠেছিল আমেরিকা। বিশ্বব্যাপী নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছিল। সাজা হয় সেই পুলিশেরও, কিন্তু ঘটনার রেশ যেন এখনও কাটছে না।
দাসপ্রথা উচ্ছেদের দেড়শ’ বছরের বেশী সময় পেরিয়ে যাবার পরও যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষগুলোর ওপর সাদাদের নির্যাতন বন্ধ হয়নি। কাগজে কলমে সব ধরনের নাগরিক অধিকার পেলেও চরম বর্ণবাদ সঙ্কটের শিকার সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী।
যুক্তরাষ্ট্রে আবারও শ্বেতাঙ্গ পুলিশের গুলিতে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় দ্রুত বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় সময় বুধবার (১৩ এপ্রিল) মিশিগান অঙ্গরাজ্যের পুলিশ একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের মাথায় এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার গুলি করছেন। পুলিশ জানিয়েছে, কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের নাম প্যাট্রিক লিওয়া। তবে পুলিশের নাম এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
পুলিশ জানিয়েছে, গত ৪ এপ্রিল এই ঘটনা ঘটেছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশ অফিসার প্যাট্রিকের উপর চেপে বসে আছেন। দুজনের ধ্বস্তাধস্তি হচ্ছে। তারপর পুলিশ অফিসার ২৬ বছর বয়সী প্যাট্রিকের মাথায় গুলি চালান। এতে তার মৃত্যু হয়।
এরই প্রতিবাদে প্রচুর মানুষ রাস্তায় নামেন। আবার শোনা যায় সেই ধ্বনি, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’। পুলিশ বিভাগের বাইরে তারা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন। তাদের দাবি, ওই শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
জানা যায়, প্যাট্রিক গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন পুলিশ তাকে থামায়। পুলিশের দাবি, প্যাট্রিকের গাড়ির নাম্বার প্লেটে গোলমাল ছিল। প্লেটটি ওই গাড়ির নয়।
পুলিশপ্রধান এরিক উইনস্টর্ম বলেছেন, এটি খুবই বেদনাদায়ক ঘটনা। পুলিশ বিভাগ স্বচ্ছতা বজায় রাখতেই পুরো ভিডিওটি প্রকাশ করেছে।
প্যাট্রিক ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর মানুষ। এরিক জানিয়েছেন, প্যাট্রিক সপরিবারে দেশ ছেড়ে আমেরিকায় পালিয়ে এসেছিলেন। কারণ, সে দেশের সহিংস পরিস্থিতিতে থাকতে চাননি তিনি। তার সামনে গোটা জীবন পড়ে ছিল।
যে পুলিশ অফিসার গুলি চালিয়েছেন, তিনি সাত বছর ধরে পুলিশ বিভাগে কাজ করছেন। তাকে সবেতন ছুটিতে পাঠানো হয়েছে বলে পুলিশ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে।
আইনজীবী বেন ক্রাম্প বলেছেন, ভিডিও থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, প্যাট্রিককে গুলি করে মারার প্রয়োজন ছিল না। কারণ, প্যাট্রিকের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না। তিনি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। এখানে পুলিশের সহিংসতাই প্রকাশ পাচ্ছে। ওই অফিসারকে বরখাস্ত ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন ক্রাম্প।
গত কয়েক বছরে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে পুলিশের সহিংসতা বেড়েছে। বিশেষ করে ২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনার পর থেকে এই ধরনের সহিংসতার অনেক ঘটনা সামনে এসেছে। প্রবল প্রতিবাদও হয়েছে। তবু সহিংসতা থামছে না।
যুক্তরাষ্ট্রে আবারও শ্বেতাঙ্গ পুলিশের গুলিতে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় দ্রুত বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (এনপিআর) এক তদন্ত প্রতিবেদনে জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে ২০১৫ থেকে ২০২০ পাঁচ বছরে ১৩৫ জন নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক নিহত হয়েছেন।
এনপিআর তাদের প্রতিবেদনে দেখায়, মোট ১৩৫ হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ৩০টির বিচার হয়েছে এবং ১৪২ মিলিয়ন ডলারের মতো অর্থদণ্ডের আদেশ জারি করা হয়েছে। কিছু কিছু মামলার শুনানি এখনো চলমান। এসব মৃত্যুর বিষয়ে পুলিশী রেকর্ডের ‘হাজার হাজার পৃষ্ঠার’ তথ্য তাদের তদন্তকারী প্রতিবেদকরা নিরীক্ষণ করেছেন।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট ৭৫ ভাগ পুলিশ কর্মকর্তাই শেতাঙ্গ। ১৯ কর্মকর্তা নিয়োগের অল্প কিছুদিনের মধ্যে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিককে গুলি করে হত্যা করেন। একজন কর্মকর্তা নিয়োগের চার ঘণ্টা পরেই কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিককে গুলি করেন। যেসব কর্মকর্তার পারিবারিক সহিংসতা ও মাদক ব্যবহারের মতো ‘সমস্যাপূর্ণ অতীত’ রয়েছে, তারাই বেশি অপরাধের সাথে জড়িত হয়েছে এবং পুলিশি নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থাও হেইট ক্রাইমের পৃষ্ঠপোষকতা করে। আমেরিকার কালো মানুষদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ, অথচ কারাগারে মোট বন্দির ৪০ শতাংশই হলো এ দেশের কালো মানুষ। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ব্রেনন সেন্টার ফর জাস্টিস-এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০-৩৪ বছর বয়সী এমন প্রতি নয়জন আফ্রিকান-আমেরিকানের একজন এখন জেলে।
আরেকটি গবেষণা বলছে, প্রতি তিনজন আফ্রিকান-আমেরিকানের মধ্যে অন্তত একজনকে জীবনে একবার হলেও জেলে যেতে হয়। যে অপরাধে এরা জেলে, একই অপরাধে সাদা বা বাদামি রঙের মানুষেরা সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়। আমেরিকায় কালোদের সামান্য অপরাধেই বড় সাজা পেতে দেখা যায়। সাদাদের ক্ষেত্রে বড় অপরাধেও তা হয় না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের শরীরের চামড়ার রঙের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র-সমাজে যে বৈষম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থা সেটার সূত্রপাত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দখল ও আধিপত্যের মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী এই দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই গভীরে শিকড় গেড়েছে যে, এর বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই সত্ত্বেও একবিংশ শতাব্দীতেও এর অবসান হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শ্বেতকায়ই কালো মানুষদের তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে এখনও প্রস্তুত নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৩
আপনার মতামত জানানঃ