বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগে এক হিন্দু পরিবারের বসতবাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়েছে। পোস্ট দেয়ার অভিযোগে যুবক কৌশিক বিশ্বাসকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। উপজেলার নিশানবাড়ীয়া ইউনিয়নের আমরবুনিয়া গ্রামে সোমবার রাত ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
খবর পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন বাগেরহাটের পুলিশ সুপার, মোংলা ও মোরেলগঞ্জে সহকারী পুলিশ সুপারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আজ মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত সাতজনকে আটক করেছে পুলিশ। যে তরুণের (২৫) বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে, তাকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত বলে জানিয়েছে পুলিশ।
স্থানীয় লোকজন জানাচ্ছেন, গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে বিভিন্ন সময়ে ইসলাম ধর্ম অবমাননা করে একটি ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট দেওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওই তরুণ (২৫) ভিন্ন নামের এই ফেসবুক আইডি থেকে এসব পোস্ট দিচ্ছিলেন বলে সন্দেহ করেন স্থানীয় লোকজন।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ওই তরুণ ভারতে ছিলেন। এক সপ্তাহ আগে তিনি এলাকায় ফিরলে ফেসবুকে দেওয়া আগের পোস্ট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে ওই তরুণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গতকাল সোমবার রাতে মিছিল বের করেন স্থানীয় লোকজন। মিছিল থেকে উত্তেজিত জনতা ওই তরুণের বাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর করে এবং উঠানে থাকা খড়ের গাদায় আগুন দেয়। তবে ঘটনার সময় ওই তরুণ বাড়িতে ছিলেন না।
মোরেলগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সপ্তাহখানেক আগে ওই যুবক ভারতে অবস্থানকালে ফেসবুকে ‘ইসলাম ধর্ম ও নবীকে কটূক্তি করে’ একটি পোস্ট দেন। সম্প্রতি ওই যুবক দেশে ফিরলে ওই ফেসবুক পোস্ট নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়।
বিষয়টি মীমাংসার জন্য সোমবার সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুর মালেক গাজী ও স্থানীয় লোকজন বৈঠক করে। ওই বৈঠককে সেই যুবক ফেসবুকে তার পোস্টের জন্য ক্ষমা চাইলে মিটমাট হয়ে যায়।
বিষয়টি মীমাংসার জন্য সোমবার সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুর মালেক গাজী ও স্থানীয় লোকজন বৈঠক করে। ওই বৈঠককে সেই যুবক ফেসবুকে তার পোস্টের জন্য ক্ষমা চাইলে মিটমাট হয়ে যায়।
কিন্তু রাত ৮টার দিকে একদল লোক ওই যুবকের ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে’ মিছিল নিয়ে তার বাড়িতে হামলা চালায় এবং ভাঙচুর করে। সে সময় একটি খড়ের গাদায় আগুন দেওয়া হয় বলে জানান ইউএনও।
পুলিশ সুপার আরিফুল হক বলেন, ‘ওই যুবকের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে একটি মন্দিরেও ভাঙচুর করা হয়েছে। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে রাতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং তাকে আটক করে’।
বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে, তবে নতুন কোনো বিশৃঙ্খলা এড়াতে ঘটনাস্থলে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানান পুলিশ সুপার।
তিনি বলেন, ‘যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের খুঁজে বের করতে তদন্ত শুরু হয়েছে। যারা জড়িত আছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।
সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মদদেই হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের ওপর এসবের দায় চাপিয়ে তারা আবারও ক্ষমতায় আসতে চায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের কারণে মানুষের মননে সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই সরকারের শাসনামলেই পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ, কওমি জননী উপাধি দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের তৈরি করা জমিতেই এখন সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের চাষ হচ্ছে।
তারা বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের উসকানি দিতে দেখা গেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই বেড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির পাহারাদার। এদের দিয়ে প্রগতিশীলতা রক্ষা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া যাবে না। সারা দেশে অব্যাহত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ করা, এর সঙ্গে জড়িত ও মদদদাতাদের গ্রেপ্তার-বিচার করা এবং হামলা-লুটপাটের দায় সরকার ও পুলিশ-প্রশাসনকে নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনায় প্রথম ও প্রধান শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। রাজনীতির হিসাব-নিকাশে বড় হয়ে ওঠে কারা তাদের ভোট পাবে, কারা পাবে না। নিরাপত্তা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে। নব্বই ও বিরানব্বইয়ের পর ২০০১ সালে এবং রামু, সাথিয়া, নাসিরনগরের ঘটনায় এর প্রমাণ মিলেছে। নির্বাচিত দল বা সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ঐ সময়ের বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বিশ্বসম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতে হয়েছে।
আমাদের দেশে যে কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় রাজনৈতিক মাঠ গরম থাকে বেশ কিছু দিন। পক্ষে-বিপক্ষে, অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগ চলতেই থাকে। সকল সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, সুশীল সমাজ রাস্তায় নামে এবং প্রতিকার খোঁজার চেষ্টা করে। তেমন সমাধান পাওয়া যায় না। মামলা হয়; কিন্তু বিচার হয় না। ফলে থামছে না নির্যাতনের ঘটনাও। অভিযোগ, নেপথ্যে ক্ষমতাসীনরা জড়িত থাকায় তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যায় না। এবারের ঘটনাতেও ক্ষমতাসীনদের জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, এ দেশের সকল ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য। এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি যুদ্ধ করে অর্জন করা। সেই মাটির অধিকার আমাদের সকলের। কেবল ধর্মের কারণে সেই অধিকারবোধ নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। যে কোনো মূল্যে এই ঐক্যের বোধ জাগ্রত রাখতে হবে। উন্নয়নের প্রকৃত সোপান সেখানেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৪
আপনার মতামত জানানঃ