বর্তমান সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে অব্যাহতভাবে লোকসান বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগজনক। রাষ্ট্রায়ত্ত ১২ প্রতিষ্ঠানে লোকসান সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। বছরের পর বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসান করছে। এর পাশাপাশি এরা ঋণ ও বকেয়া বিলে জর্জরিত।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের লোকসান কমছে না। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের লোকসান কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। লোকসান বেড়ে যাওয়ায় ভর্তুকির চাপও বেড়ে গেছে। একইভাবে সরকারি বহু প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের দায়দেনা যেমন রয়েছে, তেমনি পরিষেবা বিল বাবদও বড় অঙ্কের টাকা বকেয়া থাকছে প্রতি বছরই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, লোকসান করলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থায়ন করা হয় এবং বছরের পর বছর লোকসানি সংস্হাগুলোকে ভর্তুকি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়। পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা না করা, ব্যবস্হাপনায় অযোগ্যদের স্হান পাওয়াসহ নানা কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত লোকসান দিয়েই আসছে।
হাল আমলে এসব লোকসানের পূর্ণাঙ্গ তথ্যও প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরে সরকারি ১২টি প্রতিষ্ঠানের নিট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসের হিসাবে টিসিবি সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। এর আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংস্হাটির লোকসানের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮৬ কোটি টাকা। তবে তার আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংস্হাটি ৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা লাভ করেছিল।
করোনা পরিস্হিতিতে সাধারণ মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে কিনে তা টিসিবির মাধ্যমে কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এবছরও এই কার্যক্রম আরো বাড়ানো হয়েছে। এ কারণেই প্রতিষ্ঠানটির লোকসান বাড়ছে।
গত অর্থবছরে শীর্ষ লোকসানি সংস্হার দ্বিতীয় স্হানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। গত অর্থবছর এ সংস্হাটি লোকসান গুনেছে ৯৭১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর আগের অর্থবছর সংস্হার লোকসান ছিল ৯২৯ কোটি ৯ লাখ টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লোকসান দিয়েছিল ৭০২ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
লোকসানে থাকা তৃতীয় স্হানে নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। গত অর্থবছরে সংস্হাটি ৬৭৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা নিট লোকসান করেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে কমেছে। ঐ অর্থবছরে বিসিআইসি লোকসান করেছিল ৭০২ কোটি ১৮ লাখ টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লোকসান করেছিল ৫৭৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
সরকারি সব কটি পাটকল বন্ধ থাকায় বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) গত অর্থবছরের তুলনায় নিট লোকসানের পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বিজেএমসির নিট লোকসান হয়েছে ৩৮০ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এর আগের অর্থবছরে সংস্হাটি লোকসান দিয়েছিল ৭৭৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংস্হাটির লোকসানের পরিমাণ ছিল ৬০৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বিটিএমসির ২৫টি পাটকলের মধ্যে ২৪টি বন্ধ রয়েছে এবং একটি ভাড়ায় চলছে। বন্ধ ২৪টির মধ্যে দুটিতে টেক্সটাইল পল্লী স্হাপন এবং দুটি পিপিপিতে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) গত অর্থবছরে ১২৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।
তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি তিন কোটি ৯৩ লাখ টাকা লাভ করেছিল। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্হা (বিআরটিসি) গত অর্থবছরে লোকসান দিয়েছে ৯২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। তার আগের অর্থবছরে সংস্হাটি ১২৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা লোকসান গুনেছিল। সে হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান কিছুটা কমেছে।
তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান ছিল ১০৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) ৮১ কোটি ৬ লাখ টাকা, বাংলাদেশ মত্স্য উন্নয়ন করপোরেশন (এফডিসি) ২০ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ বস্ত্র শিল্প করপোরেশন (বিটিএমসি) ১৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিএসসিআইসি) ১১ কোটি ১৯ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।
এছাড়া লোকসানে থাকা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান হল— বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি), বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কতৃর্পক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ মৎস উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি), বাংলাদেশ বস্ত্র শিল্প করপোরেশন (বিটিএমসি) ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিএসসিআইসি)।
সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হল, সাম্প্রতিক কালে এই সকল প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। জাতীয় স্বার্থে এই সকল প্রতিষ্ঠানের লোকসানের আপডেট তথ্য প্রকাশ করার ব্যবস্থা থাকা উচিত।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে যেইখানে ৪৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লোকসানে ছিল আটটি প্রতিষ্ঠান, সেইখানে গত অর্থবছরে ১২টি প্রতিষ্ঠান লোকসান গুনেছে। এইভাবে আর কত সরকারি প্রতিষ্ঠান লোকসান গুনবে?
ঋণ ব্যবহারে বড় ধরনের দুর্নীতি ছাড়াও রাজনৈতিক প্রভাব, ট্রেড ইউনিয়নের অযাচিত হস্তক্ষেপ, অধিক জনবল, ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, পেশাদারিত্বের অভাব, মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে ব্যর্থতা, অধিক উৎপাদন ব্যয় ইত্যাদি কারণে এই সকল প্রতিষ্ঠান লোকসান দিচ্ছে নিয়মিত।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের দায়দেনা ও লোকসানের বিষয়টি দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেতস্বরূপ। কথায় বলে, ‘সরকারি মাল, দরিয়ামে ঢাল’। অর্থাৎ কোনো জিনিস যদি রাষ্ট্রের হয়, তবে সেই ক্ষেত্রে লাগামহীন অপচয়-অপব্যবহার ঘটলেও যেন কোনো সমস্যা নেই।
এই মন-মানসিকতা হতে আগে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলির জন্য দিনের পর দিন সরকারি অর্থের অপচয় ঘটছে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অর্থ হল ‘গরিবের হাতি পোষা’।
কেননা, শেষ পর্যন্ত এই লোকসানের দায় জনগণের ঘাড়েই পড়ে। ক্ষমতার অপব্যবহার, ভুয়া বিল-ভাউচারসহ নানাভাবে আর্থিক দুর্নীতির নিত্যনূতন কৌশল প্রয়োগ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে লুটপাট চালানো হচ্ছে।
বহু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিকট ব্যাংকের যেমন দায়দেনা রয়েছে, তেমন পরিষেবা বিল বাবদ বড় অঙ্কের টাকা বকেয়া রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিষেবা বিল যদি বকেয়া পড়ে থাকে বছরের পর বছর, তা হলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিল পরিশোধে উৎসাহিত হবে কীভাবে?
মূলত সরকারি শিল্পকারখানা কিংবা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানই হোক, সকলকে টিকে থাকতে হলে ব্যাবসায়িকভাবে সফল ও লাভজনক হতে হবে। এই জন্য দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিচালনা করতে হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশনকে এই ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে লোকসানের পরিবর্তে লাভজনক করতে বাজেটে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা উচিত।
এই ব্যাপারে সরকারের নীতি ও ব্যবস্থাপনার গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রয়োজন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা। এছাড়া এই সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকসানের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রধান কর্মকর্তাকে অবশ্যই দায় নিতে হবে। লোকসানি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংকট নিরসনে সরকারের নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ