সম্প্রতি প্রকাশিত কিউএস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং ২০২২-এর শীর্ষ ১০০টি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় বাংলাদেশি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
২০১৯ সালের পর থেকে এই তালিকার সেরা ১০০তে বাংলাদেশি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকা ক্রমাগত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খারাপ অবস্থান নির্দেশ করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১৪২তম। এই প্রতিষ্ঠান ছাড়া শীর্ষ ২০০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও নেই দেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। বুধবার এশিয়ার সেরা ৬৮৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করে কিউএস র্যাংকিং।
২০১৯ সালে এই তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ১২৭তম; পরবর্তী দুই বছর ২০২০ ও ২০২১ সালে এই অবস্থান এসে দাঁড়ায় ১৩৫তমতে। এছাড়া, বাংলাদেশের মাত্র ১৩টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এই তালিকায়।
সর্বশেষ র্যাংকিং অনুযায়ী, ৬৮৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২৬টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শীর্ষে রয়েছে চীন। এরপরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত এবং তৃতীয়তে রয়েছে জাপান।
তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি (বেইজিং), এবং তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি।
এর পাশাপাশি এ বছর দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ভালো অবস্থানে রয়েছে।
২০২২ সালের র্যাংকিং প্রধানত ১১টি সূচকের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এরমধ্যে একাডেমিক কার্যক্রম, পিএইচডিধারী কর্মী ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বিবেচনা করা হয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছর প্রকাশিত কিউএস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং এ অঞ্চলের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা নির্ণয় করে আসছে।
র্যাংকিং তৈরি করতে ব্যবহৃত পদ্ধতিটি কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিংয়ে ব্যবহৃত পদ্ধতির মতোই, তবে কিছু অতিরিক্ত সূচক যোগ করা হয়েছে এখানে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এশিয়ার শীর্ষ ১০০ তে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকাটা হতাশাজনক।
তিনি বলেন, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার পরিবর্তে শিক্ষক রাজনীতি নিয়েই বেশি ব্যস্ত। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার নামে ব্যবসা করছে। প্রতিটি দেশই শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ করে, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এটি দুঃখজনক।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ আখতারুজ্জামান জানিয়েছেন, তারা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন এবং গবেষণা কার্যক্রমের ওপরেও জোর দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ থেকে তালিকায় বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) রয়েছে ২০২তম অবস্থানে, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ২১৫তম, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ২৯১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ৩৫১ থেকে ৪০০-এর মধ্যে।
ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ এবং ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি ৪০১ থেকে ৪৫০-এর মধ্যে, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), এবং ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ৪৫১ থেকে ৫০০-এর মধ্যে আছে।
আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ৫০১ থেকে ৫৫০-এর মধ্যে, এবং আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (এআইইউবি) রয়েছে ৬০১ থেকে ৬৫০তম অবস্থানের মধ্যে।
কেন নিয়মিতভাবে পিছিয়ে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং কেন এত পিছিয়ে? কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান র্যাঙ্কিংয়ে সেরা ১০০-তে জায়গা করতে পারল না? প্রশ্নগুলোর উত্তর একটু চিন্তা করলে আমরা পেয়ে যাবো। সেরা র্যাঙ্কিংয়ের শর্তগুলো কী কী এবং আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অগ্রগতি কেমন।
উচ্চশিক্ষার বৈশ্বিক প্রবণতার উল্টো পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৪৩তম বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, দেশের ৬৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয় না। গবেষণার বদলে চলে মুখস্থনির্ভর পড়ালেখা, চলে চাকরিকেন্দ্রিক পড়ালেখা।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই চাকরির চিন্তা, ভবিষ্যৎ চিন্তার ঘুণপোকা ঢুকিয়ে দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে দেশের মুক্ত জ্ঞানচর্চার স্থান। শিক্ষার্থীরা গবেষণা করবেন, নতুন নতুন উদ্ভাবন করবেন, জাতিকে বিশ্বদরবারে মেলে ধরবেন এটাই হওয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্দেশ্য। কিন্তু হচ্ছে ঠিক ব্যতিক্রম।
শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া হচ্ছে কিছু পাঠ্যবই, লেকচার শিট, মুখস্থনির্ভর পরীক্ষা আর নামমাত্র রিসার্চ পেপার, যার যথার্থতা শিক্ষকেরা ঠিকভাবে বিচার করেও দেখেন না। তাদের মুক্ত জ্ঞানচর্চার সুযোগ না দিয়ে বরং ক্লাসে বাধ্যতামূলক উপস্থিতি, এসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশনের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা হয়।
এই যদি হয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক অগ্রগতির হিসাব, তাহলে আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত, পিছিয়ে পড়া স্বাভাবিক নয় কি?
সবচেয়ে বড় বিষয় এটিই, গবেষণা খাতই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং মাপকাঠির অন্যতম জায়গা; অথচ এখানেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যর্থতা বেশি। এর জন্য দু’টি বিষয়কে প্রধানত দায়ী করা যায়।
শিক্ষকদের অপর্যাপ্ত গবেষণামূলক শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে অপর্যাপ্ত বাজেট। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে বরাদ্দের হারের চিত্র খুবই হতাশাজনক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ১৪ কোটি টাকা। এ বরাদ্দ মোট বাজেটের ২ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে গবেষণায় বরাদ্দ ছিল ১ শতাংশ, যা বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ঠাঁই না পাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচ্য।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে হলে র্যাঙ্কিংয়ে ভালো অবস্থানে পৌঁছতে হলে গৎবাঁধা নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে উঠে অগ্রসর হতে হবে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা সৃজনীশক্তি দিয়ে নতুনত্ব উপহার দিতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীরা মুখস্থনির্ভর পড়ালেখা, চাকরিকেন্দ্রিক পড়ালেখাকে একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনায় না নিয়ে সৃজনশীলতার দিকে মনোনিবেশ করতে পারেন, তা শিক্ষকদের বিবেচনায় নিতে হবে। তা না হলে শিক্ষার্থীরা গতানুগতিক গণ্ডির বাইরের বিশাল নতুনত্বের স্বাদ উপভোগে ব্যর্থ হবেন।
এছাড়া, জাতীয় ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং প্রকাশ করতে হবে, যাতে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে যেতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ