কক্সবাজারে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ওপর বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বাধা বাড়াচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। এ নতুন বাধা রোহিঙ্গাদের জীবিকা অর্জন, শিক্ষা এবং ক্যাম্পের ভেতরে স্বাধীনভাবে চলাচলে আরোপ করা হয়েছে। আজ সোমবার(০৪ এপ্রিল) সংস্থাটির ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তিতে এসব বিষয়ে বলা হয়।
এতে জানানো হয়, নতুন করে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ক্যাম্প এলাকার ভেতর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার ওপর বাধা সৃষ্টি করছে। সেখানে দায়িত্বরত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য অনুমতিপত্র চাইছে। অনেক ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের মারধরের ঘটনাও ঘটেছে।
এ ছাড়া ক্যাম্প এলাকাতে রোহিঙ্গাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য থাকা হাজারের মতো দোকান ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আর ক্যাম্প এলাকাতে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকার বিষয়টি গভীর উদ্বেগের বলে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে। যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে রোহিঙ্গাদের কাজ করার অনুমতি নেই। তারপরও অর্ধেকের মত রোহিঙ্গা ঝুঁকি নিয়ে অনানুষ্ঠানিক কাজে জড়িত, যা রোহিঙ্গাদের গ্রেপ্তার এবং শোষণের সুযোগ তৈরি করে দেয়।
আর রোহিঙ্গাদের শিক্ষার ওপরও নতুন বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। গত ডিসেম্বর থেকে রোহিঙ্গাদের দ্বারা পরিচালিত কমিউনিটি স্কুলগুলো বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। এতে প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষার্থী ক্ষতির শিকার হয়েছে।
এইচআরডব্লিউ অভিযোগ করেছে, শরণার্থী ও মানবিক সহায়তাকারীরা কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের ওপর এ ধরনের বাধাগুলো তাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেখছে।
রোহিঙ্গাদের আত্মনির্ভরশীলতা বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগগুলোকে আনুষ্ঠানিকীকরণ ও সম্প্রসারণ করা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে বোঝা। কিন্তু কাজ ও পড়াশোনার সুযোগ থেকে রোহিঙ্গাদের বাদ দেওয়া হলে সাহায্যের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা আরও বাড়বে।
মীনাক্ষী গাঙ্গুলি আরও বলেছেন, রোহিঙ্গাদের আত্মনির্ভরশীলতা বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগগুলোকে আনুষ্ঠানিকীকরণ ও সম্প্রসারণ করা।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী সামরিক অভিযানের শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। সেই অভিযানে রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, ব্যাপকমাত্রায় গণহত্যার শিকার হয় রোহিঙ্গারা। বহু রোহিঙ্গা নারীকে ধর্ষণ করে মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা। সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।
এর আগে রোহিঙ্গারা বেশ কয়েক দশক ধরেই মিয়ানমারে পদ্ধতিগত ভাবে বৈষম্য, ভোটাধিকার হরণ, নিয়মিত সহিংসতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া ও নিপীড়ন শিকার হয়ে আসছিল।
চলমান রোহিঙ্গা সংকট সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য একটি ট্র্যাজেডি। পৃথিবীর কেউই শরণার্থী শিবিরে স্বেচ্ছায় থাকতে চান না। বাস্তুচ্যুত অনেক মানুষকে একসঙ্গে কেউ আশ্রয়ও দিতে চায় না। বিশ্বব্যাপী অন্যান্য অনেক শরণার্থীর মতো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ নিজ দেশে ফিরতে চায়।
বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতায় দেশি-বিদেশি সংস্থার অর্থায়নে রাখাইনের দুর্বিষহ জীবন-যন্ত্রণা অনেকটা ভুলে গেছে রোহিঙ্গারা। ইতোমধ্যে প্রায় ২৩ হাজার রোহিঙ্গার নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত হয়েছে ভাসানচরে। কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে সরিয়ে তাদের সেখানে স্থানান্তরিতও করা হয়েছে।
কক্সবাজার বন বিভাগের হিসাব মতে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে সাড়ে ছয় হাজার একর বনভূমি বেদখল হয়ে গেছে। অকল্পনীয় ক্ষতি হয়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের। পাহাড় কাটায় বদলে গেছে ভূমির প্রকৃতি। ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস ও কার্যক্রমের প্রভাব পড়েছে আশপাশের বিস্তৃত জনপদে। নষ্ট হচ্ছে কৃষিজমি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে বন ও জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হওয়ার পাশাপাশি ক্রমশ মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে এ অঞ্চল।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নানাভাবে চেষ্টার কমতি নেই। তবে মিয়ানমারের টালবাহানার কারণে এখনও পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই বললে চলে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯। এসব কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ও সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হচ্ছে বলে মনে করেন অনেকেই। তবে প্রত্যাবাসন নিয়ে এখনও আশাবাদী বিশেষজ্ঞ মহল।
এদিকে সচেতন রোহিঙ্গাদের অভিযোগ প্রত্যাবাসনের বদলে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের অপরাধী প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমার সরকার। এজন্য তারা বিপথগামী রোহিঙ্গাদের দিয়ে ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলাটি প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের লক্ষ্য। এ কারণেই বিশ্ব দরবারে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরার সবরকম চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, ‘আমরা আমাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। তবে মিয়ানমার সরকার একদিকে আমাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলছে, অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের যাতে আর মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে না হয় তার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছে।’
তাদের দাবি, ক্যাম্পে এখন যেসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলছে সবই হচ্ছে মিয়ানমারের ইশারায়। তারা বিপদগামী কিছু রোহিঙ্গাকে ব্যবহার করে আল-ইয়াকিন ও আরসার নাম ভাঙিয়ে ক্যাম্পে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। এসব রোহিঙ্গাকে আর্থিকভাবে সহায়তা দিচ্ছে মিয়ানমার।
বাংলাদেশ চেয়েছিল, বিচ্ছিন্নভাবে না নিয়ে রোহিঙ্গাদের গ্রাম কিংবা নির্দিষ্ট এলাকায় পাঠানো শুরু হোক। এতে রোহিঙ্গারা স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আর মিয়ানমার চেয়েছিল এখন পর্যন্ত যেসব রোহিঙ্গার পরিচয় যাচাই চূড়ান্ত হয়েছে, তাদের নিয়েই শুরু হোক প্রত্যাবাসন।
কিন্তু গত চার বছরেও প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা যেমন এগোয়নি, তেমনি রাখাইনে পরিবেশের এমন কোনো উন্নতি হয়নি, যা রোহিঙ্গাদের আদিনিবাসে ফিরতে উৎসাহিত করে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৩
আপনার মতামত জানানঃ