সম্প্রতি দেশে কনস্টেবল থেকে শুরু করে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এসব অপরাধ ও অপকর্মের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বে অবহেলা ও ঘুষ গ্রহণ ছাড়াও চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, এমনকি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার মতো ঘৃণ্য অপরাধও আছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ফরিদপুরে মারপিট, চাঁদাবাজি ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগে সালথা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আশিকুজ্জামান ও ওই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. হান্নানের আদালতে মামলা হয়েছে। গতকাল রোববার(২৭ মার্চ) জেলার ৬ নম্বর আমলি আদালতে মামলাটি করেন ফরিদপুরের সালথা উপজেলার গট্টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মুরাদ মোল্লা।
রোববার (২৭ মার্চ) দুপুরে ফরিদপুরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৬নং আমলি আদালতে এ মামলা করেন তিনি। মামলার বাদী মুরাদ মোল্লা ফরিদপুরের সালথা উপজেলার ভাবুকদিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও গট্টি ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য।
এ মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী ইব্রাহিম হোসেন মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ফরিদপুর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া অভিযোগটি বিভাগীয় তদন্ত করে দেখার জন্য ডিআইজি (ঢাকা রেঞ্জ) এবং ফরিদপুরের পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়েছে আগামী ১৮ এপ্রিল।
মামলার এজহার সুত্রে জানা গেছে, মুরাদ মোল্লা গট্টি ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের তিন বারের নির্বাচিত ইউপি সদস্য। ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর ইউপি নির্বাচনের আগে সালথা ওসি তার কাছে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অংকের টাকা দাবি করেন। তার দাবিকৃত টাকা না দিলে তাকে নির্বাচন করতে দেবে না বলে ভয়ভীতি দেখায়। তিনি (মুরাদ) বাধ্য হয়ে ওসিকে ৭৫ হাজার টাকা দেন। পরবর্তীতে ওসি তার কাছে বিভিন্ন সময় আরও এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। তিনি (মুরাদ) চাঁদার দাবিকৃত টাকা পূরণ না করায় আক্রোশে তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ থাকার পরও তাকে ৩টি মিথ্যা মামলায় আসামি করেন। মুরাদ দীর্ঘদিন যাবৎ গুরুতর অসুস্থ, পায়ে রিং লাগানো, ক্রেচ ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না।
অভিযোগে আরও বলা হয়, গত ১৪ মার্চ রাত অনুমান ১টার দিকে পূর্ব আক্রোশের জেরে তার ভাই জিহাদকে ঘরে ঘুমানো থাকা অবস্থায় ওসি তার অধীনস্থ কিছু অফিসার ও কনস্টেবল দিয়ে কোনো মামলা বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া জিহাদকে সালথা থানায় নিয়ে যায়। মুরাদ পরদিন সকাল ৮টার দিকে সালথা থানায় গিয়ে থানার হাজত খানায় মোট ৮জন লোককে দেখতে যান। সকাল অনুমান ১০টার দিকে ওসি তার বাসভবন হতে অফিসে আসার পথে মুরাদের সাথে দেখা হয়। তখন মুরাদ ওসির কাছে জানতে চান তার ভাইকে কেন ধরে এনেছেন, কী অপরাধ করেছে। তখন অপরাধের কথা না বলে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য মুরাদের কাছে ২৫ হাজার টাকা দাবি করে আরো বলেন, যদি দাবিকৃত টাকা না দেই তাহলে তার মতো তার ভাইকেও ৩টা মামলা দিয়ে কোর্টে চালান করে দিবে। আমি চাঁদার টাকা দিতে অস্বীকার করলে আমাকে গ্রেপ্তারের ভয় দেখালে আমি থানা থেকে চলে আসি।
‘আমি পঙ্গু মানুষ। আমি নিরুপায়। আমি ওই ওসি ও এসআইর বিচার দাবি করছি।’
অভিযোগে আরও বলা হয়, মুরাদ ওসির দাবিকৃত চাঁদার টাকা না দিলে তার হুকুমে এসআই হান্নান আমার ভাই জিহাদকে থানা হাজত থেকে বের করে ভিন্ন রুমে নিয়ে রুমের জানালার সঙ্গে আমার ভাইয়ের হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়ি শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে জখম করে। ওইদিন সন্ধ্যা অনুমান সাড়ে ৭টার দিকে তার ভাই জিহাদকে মিথ্যা মামলায় আসামি করে আদালতে পাঠায়। ওই মামলায় গত ২৩ মার্চ জামিনে মুক্তি পেলে তার শরীরের আঘাত দেখে এবং সে উক্ত আঘাতের কারণে স্বাভাবিকভাবে চলা ফেরা করতে না পারায় তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।বর্তমানে সে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী ইউপি সদস্য মো. মুরাদ বলেন, ‘আমি পঙ্গু মানুষ। আমি নিরুপায়। আমি ওই ওসি ও এসআইর বিচার দাবি করছি।’
এদিকে সালথা থানার ওসি আশিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। রোববার বিকেলে ওসির নিজ অফিস কক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় তার বিরুদ্ধে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়ে লিখিত বক্তব্য দেন।
তিনি বলেন, গত ২৩ মার্চ প্রকাশিত বিভিন্ন অনলাইন ও বিভিন্ন পত্রিকায় ‘চাঁদা না পেয়ে ঘুমন্ত জিহাদকে তুলে নিয়ে বেধড়ক মারপিটের অভিযোগ ওসির বিরুদ্ধে’ শিরোনামে যে নিউজ প্রকাশিত হয়েছে তা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। প্রকৃত ঘটনা হলো- ভাবুকদিয়া গ্রামে মুরাদ মেম্বারের দল ও তার প্রতিপক্ষ হাচান মাতুব্বর এই দুদলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সংঘর্ষের পরিস্থিতি শান্ত হলে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে চলে আসে। পুনরায় খবর আসে রাতে তারা উভয় দলই পুনরায় সংঘর্ষ বাধাতে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে এমন খবরে রাতে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মুরাদ মেম্বারের ভাই জিহাদসহ আরও কয়েকজনকে দেশীয় অস্ত্রসহ আটক করে।
ওসি আরও বলেন, ওই রাতেই মুরাদ মেম্বার ও গট্টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান লাবলু থানায় আসে মুরাদের ভাই জিহাদকে ছাড়াতে। আমি তাকে ছাড়তে নারাজ হই। এতেই মুরাদ মেম্বার আমার ওপর ক্ষিপ্ত হন। জিহাদকে গ্রেপ্তার করে থানাহাজতে রাখা হয়। তাকে কোনো মারধর করা হয়নি। পরের দিন তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালতের বিচারক তাকে জেলহাজতে পাঠান। জিহাদ জামিনে মুক্তি পেয়ে তার ভাই মুরাদকে নিয়ে যে মানববন্ধন করেছে তা আমার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এছাড়া মুরাদ মেম্বার একজন গ্রাম্য দলের নেতৃত্ব দানকারী বিভিন্ন অনৈতিক সুপারিশ নিয়ে আসতো থানায়। তার এই অনৈতিক সুপারিশ না রাখার কারণে মানববন্ধন ও মিথ্যা মামলা করা হয়েছে।
সালথা থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার কোনো নির্দেশনা পেয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নে ফরিদপুর পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে আদালতের কোনো নির্দেশনা এখনো পাননি তিনি। আদালতের নির্দেশ পেলে এ ব্যাপারে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান বলেন, এ ঘটনায় জেলা পুলিশ ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু করেছে। দোষী প্রমাণিত হলে ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার হার আশংকাজনক। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে বিভিন্ন অপকর্মের। এবিষয়ে পুলিশের কর্তৃপক্ষসহ দেশের সরকাকেও নজর বাড়াতে হবে। কেননা, আইন রক্ষাকারী কর্তৃক একেরপর এক আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে দেশের আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা জন্মাবে। ফলশ্রুতিতে দেশে দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের খড়্গ চালানোর আগে পুলিশের ওপর চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, আগে পুলিশকে অপরাধমুক্তের চরিত্র অর্জন করতে হবে। নইলে সন্ত্রাসীদের নিকট পুলিশের যে ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এতে পুলিশ আর সন্তাসীদের মধ্যকার তফাৎ ঘুচে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৮
আপনার মতামত জানানঃ