গত বছর শিশু অধিকার লঙ্ঘনের চিত্র ছিল ভয়াবহ। শিশু হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, বলাৎকার, অনলাইনে যৌন হয়রানি, সরকারি শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো বছরজুড়ে অব্যাহত থেকেছে।
করোনার মধ্যেও দেশে নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতা বেড়েছে। শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন ছাড়াও ধর্ষণ ও হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটছে। করোনার জন্য ঘরকেই সর্বোচ্চ নিরাপদ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও অনেক নারী ও কন্যাশিশুর জন্য ঘরও অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। এমন ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক।
২০২১ সালে বাংলাদেশে এক হাজার ১১৭ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়। আগের বছরের তুলনায় এই হার ৭৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। পাশাপাশি একই বছর পারিবারিক সহিংসতা, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনসহ নির্যাতনের প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টায় ২৭২ জন কন্যাশিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার।
আজ রোববার প্রকাশিত জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের (এনজিসিএএফ) ২০২১ সালের কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে শুধু ২০২০ সালেই ৬২৬ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্ষণের শিকার প্রায় ১০০ জন শিশু প্রতিবন্ধী ছিল। অন্যদিকে, ৪৫ জনকে যৌন নিপীড়নের পরে হত্যা করা হয়েছিল। প্রায় ১৫৫ জন শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়।
প্রায় ৮০৪টি ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও আটক অধিকাংশই জামিনে বের হয়ে ভুক্তভোগীর পরিবারের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে বাসাবাড়িতে কাজ করা প্রায় ৩৫ কন্যাশিশু ধর্ষণসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার। এদের মধ্যে পাঁচজনকে হত্যা করা হয়। ১৮ জন শারীরিক নির্যাতন ও ১২ জন যৌন নির্যাতনের শিকার।
এছাড়া ২০২১ সালে ২৪২ জন কন্যাশিশু আত্মহত্যা করে। এদের মধ্যে ৬১ জন প্রণয়ঘটিত কারণে এবং ৫৬ জন পারিবারিক মনোমালিন্যের পর আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুদের মধ্যে হতাশা বেড়ে যায়। একই সঙ্গে যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে আনা ও মামলা করা নিরাপদ না হওয়ায় বিষয়টিও আত্মহত্যার ঘটনায় প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।
দেশের ২৪টি জাতীয়, স্থানীয় ও অনলাইন দৈনিক পত্রিকায় ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরে প্রকাশিত শূন্য থেকে ১৯ বছর বয়সী কন্যাশিশুর ওপর নির্যাতনের ঘটনা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এনজিসিএএফ।
দেশে প্রতিনিয়তই বাড়ছে শিশুর প্রতি সহিংসতা, যার কারণ আমাদের অনিরাপদ সমাজ ব্যবস্থা। ফলে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ছে কন্যাশিশুরা। আইনজীবী সুরাইয়া পারভীন বলেন, নির্যাতনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী ও শিশুর প্রতি নৃশংসতার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা সম্ভব হয়নি। দোষীদের খুঁজে বের করা বা দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং যে সকল অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে তাদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অনেক অপরাধী জামিনে মুক্ত হয়েছে, নানা কৌশলে অনেকে বিচার এড়িয়ে চলছে। তিনি আরও বলেন, নারী নির্যাতনের ঘটনা ও বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, সামাজিক, অর্থ ও ক্ষমতার প্রভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নির্যাতনের শিকার শিশু বা তার পরিবার বিচার চাইতেই ভয় কিংবা লজ্জাবোধ করছে। সমাজে ঘটনাগুলো মেনে নেওয়ার মতো প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারী-পুরুষসহ সকল শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-গোষ্ঠীর মানুষের সহাবস্থানের উপাদানগুলোকে এসব নির্যাতনের ঘটনা ধ্বংস করে সমাজ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে।
এদিকে, আইন অনুযায়ী ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না। এ অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা অনুযায়ী অতিরিক্ত মামলার চাপ থাকায় ১৮০ দিনের সময়সীমা মেনে চলা বাস্তবিকভাবে সম্ভব হয়ে ওঠে না।
তাই ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানোসহ বাজেট ব্যবস্থাপনার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। একইসঙ্গে সরকারকে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর মানসিক, আর্থিক, সামাজিক পুনর্বাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়া দেশে ৪৩ হাজার ৫৪টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত শিশু অধিকারবিষয়ক সংবাদ পর্যালোচনা করে এই প্রতিবেদন তৈরি করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। চিত্রটি ভয়াবহ।
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে প্রশাসন উদ্যোগ নিচ্ছে। সেই সঙ্গে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। সচেতন হতে হবে। বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়; করোনা মহামারির সময় এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর দায় যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি সমাজেরও।
করোনায় স্কুল বন্ধ থাকা, অভিভাবকদের কর্মহীনতা এবং নিরাপত্তাবোধ থেকে দেশে বেড়ে গেছে বাল্যবিয়ের হার। বিগত ২৫ বছরের মধ্যে এবারই এ হার সবচেয়ে বেশি। বৈশ্বিক পরিসংখ্যান বলছে- সংঘাত, দুর্যোগ কিংবা মহামারির সময় বাল্যবিয়ের সংখ্যা বাড়ে।
বর্তমানে ৪৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছরের নিচে। বাংলাদেশ এখনো বাল্যবিয়ের উচ্চহারের দেশের তালিকায় রয়েছে। বাল্যবিয়ের কারণে অনেক মেয়ে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একমাত্র বাল্যবিয়ের কারণেই মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে অনেক কিশোরীর শিক্ষাজীবন। অথচ তারা সমাজের অন্য মেয়েদের মতো শিক্ষিত, স্বাবলম্বী হতে পারত।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাল্যবিয়ে বন্ধ করার জন্য অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও সমাজের অগ্রসর নাগরিকদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বাল্যবিয়ে রোধে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হবে। আর জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, বাল্যবিয়ে নির্মূল করতে হবে ২০৪১ সালের মধ্যে। বাল্যবিয়ে রোধে অনেক বছর ধরেই সরকার সচেষ্ট। নানা পদক্ষেপ গ্রহণসহ সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনে সাজা ও জরিমানা বাড়ানো হয়েছে।
তবে এক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের দায়িত্ব যাদের, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এমনকি সংসদ সদস্যদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলে সুফল পাওয়া যাবে। সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। বাল্যবিয়ে রোধে প্রাথমিকভাবে মা-বাবাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। বাল্যবিয়ে রোধের জন্য প্রতিটি উপজেলায় যে কমিটিগুলো আছে, তা খুব বেশি সচল করতে হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/২২৫০
আপনার মতামত জানানঃ