ঢাকা-বরিশাল নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোর জন্য নীরব ঘাতক হয়ে উঠেছে ডুবন্ত বাল্কহেড। বিশেষ করে রাতে নৌপথগুলোতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এসব বাল্কহেড চলাচল করায় প্রায়ই যাত্রীবাহী নৌযানের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। অনিরাপদ হয়ে উঠেছে দেশের নৌপথ।
এমনিতেই ঢাকা-বরিশাল নৌপথে নাব্যতা–সংকটে চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অসংখ্য ডুবোচর, নদীর গতিপথ বদল হয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়াসহ নানা কারণে ঝুঁকি বেড়েছে।
তার ওপর রাতের বেলায় মেঘনা, পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, কীর্তনখোলা, সুগন্ধা, বিষখালী, পায়রা, কালবদরসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে অবাধে বালু তুলছে এসব বাল্কহেড।
সরকারি হিসাবে ৪ হাজার ৭০০টি নিবন্ধিত বাল্কহেডের কথা বলা হলেও সারা দেশের নদীতে চলছে ১০ হাজারের বেশি বাল্কহেড। অবৈধ বাল্কহেড চলছে দক্ষ মাস্টারের পরিবর্তে অদক্ষ সুকানি দিয়ে। নেই কোনো ফিটনেস।
সাম্প্রতিক কিছু দুর্ঘটনা
গতকাল শুক্রবার রাতে ঝালকাঠি থেকে ঢাকাগামী এমভি ফারহান-৭ নামের একটি লঞ্চের সঙ্গে বালুবাহী বাল্কহেডের সংঘর্ষ হয়। এতে বাল্কহেডটি ডুবে যায়। সুগন্ধা নদীতে এ সংঘর্ষে লঞ্চটির সামনের অংশ ফেটে যায়।
এই দুর্ঘটনার ফলে অল্পের জন্য রক্ষা পায় লঞ্চটির তিন শতাধিক আরোহী। পরে লঞ্চটি পাশের চরে নোঙর করে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে যাত্রা বাতিল করতে বাধ্য হয়।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে বরিশালগামী এমভি সুরভী-৭ নামের একটি লঞ্চের সঙ্গে বাল্কহেডের সংঘর্ষে বাল্কহেডের একজন মারা যান। এতে লঞ্চটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এর আগে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি চাঁদপুরে ডাকাতিয়া নদীতে বালুবাহী আরেকটি বাল্কহেডের ধাক্কায় মাটিবাহী ট্রলার ডুবে পাঁচজনের মৃত্যু হয়।
বাল্কহেডের ধাক্কায় আরও যত দুর্ঘটনা
গত বছরের ৩ মে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌপথে কাঁঠালবাড়ী ঘাট–সংলগ্ন এলাকায় বাল্কহেডের ধাক্কায় স্পিডবোট দুর্ঘটনায় ২৬ জনের প্রাণহানি হয়।
গত বছরের ২১ মে রাতে ঢাকা থেকে লালমোহনের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া এমভি গ্লোরি অব শ্রীনগর-২ লঞ্চটির সঙ্গে বালুবাহী বাল্কহেডের সংঘর্ষ হয়। মেঘনায় ঘটে যাওয়া ওই দুর্ঘটনায় লঞ্চটির ডানদিক পানিতে ডুবে গেলে আড়াই শ যাত্রীকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়।
এর তিন দিন পর ২৪ মে রাতে কয়েক শ যাত্রী নিয়ে বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে এমভি মানামী মধ্যরাতে ঝড়ের কবলে পড়ে। মেঘনায় লঞ্চটি যখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যায়, তখন হঠাৎ একটি বাল্কহেড ঢেউয়ের তোড়ে লঞ্চটির মাঝ বরাবর হামলে পড়ে। এতে লঞ্চের নিচ তলা ও দ্বিতীয় তলার কেবিনসহ বেশ কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এক যাত্রী গুরুতর আহত হন।
একই রাতে পটুয়াখালী থেকে ঢাকায় ৩০০ যাত্রী নিয়ে যাওয়ার পথে প্রথমে ঝড়ে ও পরে ভাটার কারণে আটকে পড়ে এমভি যুবরাজ-৭ লঞ্চ। সব প্রতিকূলতা এড়িয়ে সকালে যখন লঞ্চটি যাত্রা শুরু করে, তখন মেঘনা নদীর মিয়ারচরে একটি বাল্কহেড সেটিকে ধাক্কা দেয়। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে তলা ফেটে গেলে লঞ্চটি দ্রুত চরে তোলা হলে যাত্রীরা প্রাণে বেঁচে যান।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
মাস্টার-চালকদের ভাষ্য, এসব বাল্কহেডে রাতের বেলা চলাচলের জন্য কোনো সংকেতবাতি নেই, সার্চলাইট নেই। পাশাপাশি নেই দক্ষ মাস্টার-চালক। পানির নিচে ডুবন্ত থাকায় লঞ্চের উচ্চ ক্ষমতার সার্চলাইটেও এসব বাল্কহেডের অস্তিত্ব বোঝা যায় না। ফলে প্রায়ই এসব ডুবন্ত বাল্কহেড নৌ দুর্ঘটনার কারণ হয়।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ-স্টিমার ও জাহাজের যাত্রা নিরাপদ করতে রাতে বাল্কহেডসহ পণ্যবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশনা রয়েছে। তবে রাতে বাল্কহেডসহ পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়নি বলে দাবি করেছেন লঞ্চের মাস্টাররা।
লঞ্চচালক ও মাস্টারদের দাবি, ফতুল্লার মোড়ে অধিকাংশ সময় তিনটি ট্যাংকার নোঙর করে রাখা হয়। ফলে এই স্থানেরও নৌপথ সরু হয়ে গেছে। মুন্সীগঞ্জ মোড় থেকে মোহনপুর পর্যন্ত দিনে-রাতে বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল করায় লঞ্চচালকেরা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অভিযানের পর চার–পাঁচ দিন বন্ধ থাকলেও আবার নদীতে নামে বাল্কহেড।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বাল্কহেডের চালক বলেন, ১৫ বছর আগে একটি বাল্কহেডে লস্কর (নোঙর ফেলেন যিনি) হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। এ কাজ করার সাত বছর পর সুকানি (মাস্টারের সহযোগী হিসেবে যিনি নৌযান পরিচালনা করেন) বাল্কহেড চালাতে শুরু করেন। প্রশিক্ষণ না থাকলেও তিনি এখন চালক (ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণ করেন)।
তিনি বলেন, তার প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ও সনদ নেই। সিগন্যাল বুঝতে না পারার কারণে বাল্কহেড চালাতে গিয়ে বেশ কয়েকবার তিনি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
এমভি সুন্দরবন লঞ্চের মাস্টার মো. আলম বলেন, রাতে অবৈধভাবে নদীতে যারা বালু উত্তোলন করেন, তাদের যেমন ঠেকাতে হবে, তেমনি যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলের পথে রাতে বাল্কহেড-কার্গোসহ ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। মাছ শিকারের জাল ফেলাও বন্ধ করতে হবে। নয়তো দুর্ঘটনার শঙ্কা থেকেই যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের বরিশাল অঞ্চলের যুগ্ম পরিচালক এবং বরিশাল বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাল্কহেড নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নৌ পুলিশের। এ বিষয়ে বারবার আমরা চিঠি দিচ্ছি। রাতে বাল্কহেড না চলার বিষয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। রাতের আঁধারে নদীতে বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হলেও মানা হচ্ছে না বেশির ভাগ নদীতে।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১৫
আপনার মতামত জানানঃ