কোভিডকালে অনলাইনমুখী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক প্রসারের সুযোগ নিয়েছে সুযোগসন্ধানী অপরাধী চক্র। এ সময়ে অধিক পরিমাণ জালিয়াতির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) রেকর্ড ৫,২৮০টি সন্দেহজনক লেনদেন এবং কার্যকলাপের প্রতিবেদন পাঠিয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে গঠিত কেন্দ্রীয় সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। সংস্থাটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেছে।
গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে বিএফআইইউ এর এক মতবিনিময় সভায় এই বার্ষিক রিপোর্ট তুলে ধরেন সংস্থাটির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার কামাল হোসেন।
তার মতে, এই প্রবণতা আসলে ইতিবাচক কারণ, এই হার বৃদ্ধি অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃঢ় প্রতিশ্রুতিই নির্দেশ করে।
এদিকে বিএফআইইউ-এর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টিং (এসটিআর) এবং সন্দেহজনক কার্যক্রম রিপোর্টিংয়ের (এসএআর) অধিক পরিমাণ বৃদ্ধির কারণ এই নয় যে, দেশে টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। এটা বরং এ সংস্থার আরও সক্রিয় ভূমিকার প্রমাণ।
তিনি বলেন, “এটি একটি ভাল লক্ষণ যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এবং অন্যান্য রিপোর্টিং এজেন্সিগুলো অর্থ পাচার এবং সন্ত্রাসী অর্থায়নের বিরুদ্ধে সন্দেহজনক লেনদেন এবং কার্যকলাপের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “মহামারিকালীন সময়ে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং ই-কমার্স খাতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটিয়েছে। একই সময়ে অজস্র অর্থ আত্মসাৎ এবং আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগও উঠে এসেছে। মানি লন্ডারিংয়ে তাদের সম্পৃক্ততা যাচাই করতে এ সংস্থা সফলভাবে কিছু কোম্পানির আর্থিক লেনদেন গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছে।”
সংস্থাটি গত বছর বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে ১,৪১৪টি ঘটনার আর্থিক তথ্য দিয়েছে – যা পূর্বের চেয়ে ৮০ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছর এ সংখ্যা ছিল ৭৮৭টি।
গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা
অনলাইন পেমেন্ট চালু হওয়ার পর থেকে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকে। করোনা মহামারির মধ্যে এই খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটে।
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে বর্তমানে লেনদেনের পরিমাণ কমপক্ষে ১৬ হাজার কোটি টাকা বা প্রায় প্রায় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২৩ সালে এই খাত তিন বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে জার্মান প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
গবেষণায় জানা গেছে, বাংলাদেশে কমপক্ষে দুই হাজার ই-কমার্স সাইট এবং ৫০ হাজারের বেশি ফেসবুকভিত্তিক ই-কমার্স পেজ রয়েছে।
তবে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির বিভিন্ন অনিয়ম গণমাধ্যমে আসলে সমস্যা শুরু হয়।
ইভ্যালির অনিয়ম নিয়ে গত বছর ২৩ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশির সভাপতিত্বে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেন, ইভ্যালির কাছ থেকে গ্রাহকরা ৭৫০ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আরও ২৫০ কোটি টাকা পাবে। তবে গ্রাহকদের ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে টাকা ফেরত দেবার সামর্থ্য ইভ্যালির নেই বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ই-কমার্স জগতে হইচই ফেলে দেয় ইভ্যালি। বিভিন্ন অফারের মাধ্যমে শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট দিয়ে পণ্য বিক্রি করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি।
ব্যাপক ডিসকাউন্টের কারণে সাধারণ ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে টাকা দেয় ইভ্যালিকে। এক পর্যায়ে এত টাকার বিপরীতে গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহে আটকে যায় প্রতিষ্ঠানটি।
পণ্য এবং টাকা কোনোটি না পেয়ে রাস্তায় নামেন গ্রাহকেরা। গত ১৬ সেপ্টেম্বর অর্থ আত্মসাৎ ও চেক জালিয়াতির অভিযোগে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী এবং ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এখন তাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলার কার্যক্রম চলমান। এতে বন্ধ হয়ে যায় ইভ্যালির ব্যবসায়িক কার্যক্রম।
এরপর চীনের ই-কমার্স জায়ান্ট আলিবাবার মালিকানাধীন দারাজ ও প্রিয়শপসহ দেশের ২৩টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফইইউ)। এর আগে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণার অভিযোগে ৪৯টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে সরকার।
স্বাস্থ্য খাতে কেলেঙ্কারি
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু করোনাভাইরাস সংকট শুরু হওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থার চিত্রটি প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে।
দরকারি উপকরণের অভাব, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ, হাসপাতালে সেবার অভাব, নিয়োগ আর কেনাকাটায় একের পর এক দুর্নীতির খবর যেন এই খাতের বেহাল দশাকেই তুলে ধরেছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে সংস্থাটি বিভিন্ন তদন্ত এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে সন্দেহজনক লেনদেন এবং কার্যকলাপের ৭৩টি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিপরীতে আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ১১৬।
সংস্থার মতে, অফিসের টাইম কমায় গত বছর প্রতিবেদন প্রকাশের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
সবচেয়ে বেশি প্রতিবেদন করা হয়েছে জালিয়াতির কারণে। স্বাস্থ্য খাতের প্রতারণা ও দুর্নীতির জন্য ২১টি প্রতিবেদন করা হয়েছে। এছাড়া ঘুষ লেনদেন জাতীয় প্রতারণায় ১৬টি প্রতিবেদন করা হয়।
মহামারির সময়ে এই খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির পরিমাণ অনেক বেড়েছে বলে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, করোনাভাইরাস মহামারিকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির মহোৎসব হচ্ছে।
গত বছর বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে যে সাংবাদিক সবচেয়ে বেশি রিপোর্ট করেছেন, সেই রোজিনা ইসলামকে পাঁচ ঘণ্টা মন্ত্রণালয়ে আটকে রাখার পর অফিসিয়াল সিক্রেক্টস অ্যাক্টের এক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
স্বাস্থ্যখাতে ১৮০০ চাকরির নিয়োগ নিয়ে কোটি টাকার ঘুষের প্রস্তাব, স্বাস্থ্যের সাড়ে তিনশো কোটি টাকার কেনাকাটায় অনিয়ম- এরকম অনেকগুলো প্রতিবেদন তৈরি করেন রোজিনা ইসলাম।
তালিকা আছে, কিন্তু প্রকাশ সম্ভব নয়
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত অর্থ পাচারকারীদের তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, সে তথ্য পরিপূর্ণ নয়।
তিনি বলেন, “আমাদের কাছে অর্থ পাচারকারীদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য রয়েছে, তবে তা প্রকাশ করা যাচ্ছে ন।
মতবিনিময় সভায় সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির তার লিখিত বক্তৃতায় প্রতিবেদনটির প্রশংসা করেন এবং বলেন, বিএফআইইউ ই-কমার্স জালিয়াতি মোকাবিলায় যথেষ্ট সতর্ক।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ