ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাইরে থেকে যে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছিল, তা আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর রয়টার্সের।
স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্রিড অপারেটরের পক্ষ থেকে বলা হয়, সবশেষ ঘটনার পর ডিজেলচালিত জেনারেটর ব্যবহার করে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া বক্তব্যে গ্রিড অপারেটরটির প্রধান ভলোদিমির কুদরস্কি বলেন, একই কারণে পার্শ্ববর্তী শহর স্লাভ্যুটিচ পুরোপুরি বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে।
তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর সম্ভাবনা
১৯৮৬ সালের বিপর্যয়ের পর থেকে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে চেরনোবিল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়া সামরিক অভিযান শুরু করে। অভিযান শুরুর পরপরই রুশ বাহিনী কেন্দ্রটির দখল নেয়।
এর আগে ৯ মার্চ চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তখন ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন সংস্কারের জন্য জরুরি ভিত্তিতে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন থাকলে কেন্দ্রটি থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে পারে।
গত রোববার বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে আবার বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছিল। তখন ইউক্রেনের জ্বালানিমন্ত্রী বলেন, জ্বালানিবিষয়ক প্রকৌশলীরা নিজেদের জীবন ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়েই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন।
এনডিটিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতকাল গ্রিড অপারেটরটি জানায়, বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি সচল হওয়ার আগেই লাইনটি আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি সংস্কারের জন্য কাজ চলছে।
গত মাসে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর পর আক্রমণের প্রথম দিনেই রুশ বাহিনী চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দখল করে নেয়। এখানেই গত শতকের আশির দশকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটেছিল।
চেরনোবিল এখন আর কার্যকর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয়। তবে কখনোই এটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়নি। এখনো এর নিয়মিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
রাশিয়ার সেনাদের কর্তৃত্বের অধীনে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে থাকা ইউক্রেনীয় কর্মীদের জন্য উদ্বেগ রয়েছে। কর্মীরা তাদের দায়িত্ব পালন চালিয়ে যাচ্ছেন। পরিবেশও শান্ত বলে জানা গেছে। তবে বিবিসিকে বলা হয়েছে, ভেতরের পরিস্থিতি কঠিন। খাবার ও ওষুধের মজুদ সীমিত।
ভয়ঙ্করতম পারমাণবিক বিপর্যয়
পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম পারমাণবিক বিপর্যয়ের কেন্দ্রস্থল চেরনোবিল। ১৯৮৬ সালের এপ্রিলে সেখানকার চুল্লিতে বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তের মধ্যে সেখান থেকে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে, যা গ্রাস করে ফেলে দেড় লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের বেশি অঞ্চলে। হিরোশিমা-নাগাসাকির তুলনায় চেরনোবিল থেকে ৫০০ গুণ বেশি তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায় বলে জানা যায়। রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ এমনকি চিন এবং আমেরিকাতেও তার প্রভাব টের পাওয়া গেছিল।
ওই দুর্ঘটনার প্রভাবে উত্তর ইউরোপের বায়ুমণ্ডলে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। সুইডেনের পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, নিজেদের দেশেই কিছু ঘটেছে বলে প্রথমে ধারণা জন্মায় তাদের। তাই তড়িঘড়ি সুইডেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে জানা যায় চেরনোবিলে বিপর্যয় ঘটেছে।
তবে আজও চেরনোবিলের ধ্বংসস্তূপ পুরোপুরি পরিষ্কার করা যায়নি। এখনও সেখানে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ রয়েছে বলে দাবি বিজ্ঞানীদের। সব কিছু পরিষ্কার করে ২০৬৫ সালের আগে সম্পূর্ণ ভাবে সেটিকে নিরাপদ ঘোষণা করা সম্ভব নয় বলে দাবি তাদের।
এবার ইউক্রেনের সেনাদের থেকে দেশটির চেরনোবিলে অবস্থিত এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন রুশ সেনারা। ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ বলেছে, চেরনোবিল অঞ্চলে পারমাণবিক বিকিরণের মাত্রা বেড়েছে। রুশ সেনাদের আক্রমণের ফলে সেখানে ‘ভয়াবহ পরিণতি’ হতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছে দেশটি।
১৯৮৬ সালে চেরনোবিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিস্ফোরণকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্যোগ, ক্ষতি ও মৃত্যু, দুই হিসেবেই মনে করা হয়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট সতর্ক করেছেন যে রুশ বাহিনী তাদের অভিযান অব্যাহত রাখলে চেরনোবিলের মত আরেকটি বিপর্যয় আবারো ঘটতে পারে।
ওই বছর দু’টি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রটির পরমাণু চুল্লি। সেই বিস্ফোরণে চুল্লির উপরের প্রায় দু’হাজার টন ওজনের ধাতব ঢাকনাটি উড়ে যায় এক লহমায়। তার পর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে লাগোয়া এক হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকায়।
এরপর বন্ধ করে দেওয়া হয় পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন। বিকিরণের ছোবল থেকে মানুষকে বাঁচাতে পরে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রের বাইরে বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা হয় এক্সক্লুসন জোন।
সেই সময়েই বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ২৪ হাজার বছর ওই এলাকা আর মানুষের বসবাসের পক্ষে উপযোগী করে তোলা সম্ভব হবে না।
তারপরেই শুরু হয় সেই এক্সক্লুসন জোনে নিয়মিত বিকিরণ মাপার কাজ। যাতে আগামী দিনে পারমাণবিক বর্জ্য থেকে লাগোয়া এলাকাগুলিতে কোনও বিপদের সঙ্কেত আগেভাগেই মেলে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ